Track II Diplomacy: ধারণা, তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা
ভূমিকা
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কূটনীতি (Diplomacy) একটি মৌলিক হাতিয়ার, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহ তাদের পারস্পরিক স্বার্থ, দ্বন্দ্ব, সহযোগিতা ও সম্পর্কের জটিলতা প্রভৃতি নিরসনে কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রচলিত ভাষায় কূটনীতি হলো সরকারী প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপ্রধান, বা পেশাদার কূটনীতিকদের মাধ্যমে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক আলোচনা (Formal Negotiation)। এই ধারা পরিচিত Track I Diplomacy নামে। তবে আধুনিক সময়ের বিশ্ব রাজনীতির বাস্তবতায় এটা প্রতীয়মান যে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক আলোচনার অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, বিশেষত গভীর দ্বন্দ্ব, আস্থার সংকট এবং রাজনৈতিক স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোতে।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮০-এর দশকে Joseph Montville “Track II Diplomacy” ধারণাটি উপস্থাপন করেন। Track II Diplomacy মূলত একধরনের অনানুষ্ঠানিক (informal), অপ্রাতিষ্ঠানিক (unofficial) এবং বে-সরকারি (non-governmental) আলোচনা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জাতীয় নীতি-নির্ধারক, একাডেমিক, গবেষক, গণমাধ্যমকর্মী, প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি সংস্থা (NGO) বা নাগরিক সমাজের (Civil Society) প্রভৃতির নানা অংশীজন আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। Track II Diplomacy এর প্রধান উদ্দেশ্য পারস্পারিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা, আত্ম-বিশ্বাস তৈরি করা, এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করা, যাতে Track I কূটনীতির জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়। Track II Diplomacy সরাসরি কোনো রাজনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় না; বরং চুক্তিটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে একটি আস্থার সম্পর্ক বিনির্মানে কাজ করে। এই ধরনের কূটনীতিতে অংশগ্রহণকারীরা স্বাধীনভাবে ও অনানুষ্ঠানিক মতামত বিনিময় করতে পারেন এবং সম্ভাব্য সমাধানপথ সুপারিশ করতে পারেন। এর ফলে Track I কূটনৈতিক প্রক্রিয়া হয় আরো সহজতর ও কার্যকর।
বিশেষত স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী (Post–Cold War Era) আন্তর্জাতিক সিস্টেমে সংঘাত ও নিরাপত্তা ঝুঁকির ধরন বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। যেমন: সামরিক ঝুঁকির বাহিরেও জাতিগত সহিংসতা, গৃহযুদ্ধ, মানবাধিকার সংকট, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ, এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধ। এসব জটিল ইস্যু মোকাবিলায় কেবল Track I Diplomacy যথেষ্ট ছিলো না। ফলে, Track II Diplomacy বিকল্প আলাপ–আলোচনার প্ল্যাটফর্ম বা Track I Diplomacy এর সহযোগী হিসেবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
Track II Diplomacy কী?
অ–সরকারি, অনানুষ্ঠানিক ও অ–প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার (Negotiation) মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলা ও সমাধানের প্রচেষ্টাকে সহজভাষায় Track II Diplomacy বলা হয়। মার্কিন শিক্ষাবিদ Joseph V. Montville ১৯৮১ সালে প্রথমবারের মতো “Track II Diplomacy” শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন। তাঁর মতে, এটি এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বাইরে থাকা অংশীজনেরা, যেমনঃ একাডেমিক, প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা, গবেষক, এনজিও প্রতিনিধি, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি প্রমূখ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটময় পরিস্থিতিতে পারস্পারিক বোঝাপড়া ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজ করে। Montville এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, Track II Diplomacy মূলত সমস্যা সমাধানে প্রচেষ্টা যা অ-রাষ্ট্রীয় অংশীজনের অনানুষ্ঠানিক সংলাপের মাধ্যমে পরিচালিত এক কূটনৈতিক প্রক্রিয়। এখানে অংশগ্রহণকারীরা রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক চাপমুক্ত পরিবেশে নিজস্ব কায়দায় সংকট সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়। এর মাধ্যমে তারা সংকটের অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান করেন এবং সম্ভাব্য সমাধানের পথ সুপারিশ করেন। যদিও এসব আলোচনার কোনো আনুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা নেই, তবুও সেগুলো পরবর্তী সময়ে Track I Diplomacy অর্থাৎ সরকারি আলোচনার ভিত্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
Track II Diplomacy–এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর অনানুষ্ঠানিকতা ও নমনীয়তা। যেহেতু এটি রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার বাইরে পরিচালিত আলোচনা, তাই অংশগ্রহণকারীরা সংবেদনশীল ও বিতর্কিত ইস্যু নিয়েও খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, Middle East Peace Process–এর প্রাথমিক পর্যায়ে ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের প্রতিনিধিদের মধ্যে যে গোপন আলোচনা হয়েছিল, তা ছিল একটি Track II কূটনৈতিক উদ্যোগ, যা পরবর্তীতে “Oslo Accords (1993)”–এর পথ সুগম করে।
Track II Diplomacy–এর প্রধান বৈশিষ্ট্যঃ
Track II Diplomacy, কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে Track I Diplomacy এর থেকে আলাদা। যথাঃ
ক। কূটনীতির বে/অ-সরকারি রূপঃ Track II Diplomacy–এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর অ-সরকারি রূপ। এই কূটনীতিতে রাষ্ট্রের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন না। বরং এতে অংশগ্রহণ করেন প্রাক্তন কূটনীতিক, একাডেমিক, গবেষক, এনজিও কর্মী, সাংবাদিক বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ। এর ফলে সংলাপগুলোতে রাজনৈতিক চাপ বা রাষ্ট্রীয় অবস্থান মেনে চলার কোন বাধ্যবাধকতা থাকে না। যেমনঃ ১৯৯০-এর দশকে ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে Neemrana Dialogue নামে পরিচিত Track II কূটনৈতিক উদ্যোগ শুরু হয়। এতে অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা, একাডেমিক ও ব্যবসায়ী নেতারা অংশ নেন। তারা কাশ্মীর ইস্যু, সন্ত্রাসবাদ ও বাণিজ্য সহযোগিতা নিয়ে আলোচনায় যুক্ত হন, যদিও তারা সরাসরি সরকারকে প্রতিনিধি ছিলেন না।
খ। আলোচনার স্বাধীনতা থাকবেঃ Track II আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা স্বাধীনভাবে মতামত বিনিময় করতে পারেন। এখানে নমনীয়তা বেশি থাকে কারণ তারা কোনো সরকারী অবস্থানকে রক্ষা করতে দায়বদ্ধ থাকেন না। এ ধরনের স্বাধীনতা অংশগ্রহণকারীদেরকে পারস্পারিক সংবেনশীল ইস্যু নিয়েও খোলামেলা আলোচনা করার সুযোগ দেয়। যেমনঃ ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে নরওয়েতে যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ গোপনীয় ও অনানুষ্ঠানিক ছিল। অংশগ্রহণকারীরা আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াই আলোচনা করেছিলেন। এই Track II প্রক্রিয়াই পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত Oslo Accords–এর ভিত্তি রচনা করে।
গ। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আগানোঃ Track II Diplomacy–এর লক্ষ্য তাৎক্ষণিক কোনো চুক্তি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক উন্নয়ন। অংশগ্রহণকারীরা ভবিষ্যতের জন্য পারস্পারিক আস্থা, বোঝাপড়া ও সহযোগিতা গড়ে তোলার দিকে গুরুত্ব দেন। যেমনঃ Council for Security Cooperation in the Asia Pacific (CSCAP) একটি Track II সংলাপমঞ্চ যেখানে গবেষক, একাডেমিক ও নীতি–বিশ্লেষকরা নিয়মিত আলোচনায় যুক্ত হন। এটি সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত দেয় না, তবে দীর্ঘমেয়াদে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতা গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
ঘ. মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনাঃ Track II Diplomacy প্রচলিত Track I Diplomacy–এর “রাষ্ট্রীয় স্বার্থই মূখ্য” এই নীতির বাইরে গিয়ে সাধারণ জনগণের অভিজ্ঞতা ও চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়। এটি মানবিক মর্যাদা, মানব নিরাপত্তা, সহযোগিতা, শান্তি-বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থাকে। যেমনঃ আফ্রিকার বুরুন্ডি ও সুদানের সংঘাতের সময়ে অত্র দেশের নাগরিক সমাজ, ধর্মীয় চার্চ এবং স্থানীয় এনজিও Track II Diplomacy–র মাধ্যমে শান্তি আলোচনায় যুক্ত হয়। তারা ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের অভিজ্ঞতা ও দুঃখ–কষ্টকে আলোচনায় তুলে ধরে, যা Track I প্রক্রিয়ার বাইরে থেকেও রাজনৈতিক সমঝোতার পথকে প্রভাবিত করে।
ঙ. পারস্পারিক আস্থা অর্জনে প্রচেষ্টা চালানোঃ Track II কূটনীতি সংঘাতপূর্ণ পক্ষগুলির মধ্যে আস্থা পুনর্গঠন করতে সাহায্য করে। যেসব পক্ষ Track I আলোচনায় একে অপরের প্রতি সন্দেহপ্রবণ, তারা অনানুষ্ঠানিক ফোরামে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে পারস্পারিক বিশ্বাস, আস্থা ও আত্ম-বিশ্বাসের জায়গা গড়ে তোলে। যেমনঃ ভারত–পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে Track II আলোচনায় পরমাণু নিরাপত্তা ও সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে আস্থা গড়ার প্রচেষ্টা চলমান একটি প্রক্রিয়া।
চ. সমস্যা সমাধানমুখী আলোচনাঃ John Burton তার Conflict Resolution School of Thought নামক তত্ত্বে বলেন যে, Track II diplomacy অনেক সময় সমস্যা সমাধানে গুরুত্ব দেয়, অর্থাৎ তাদের আলোচনার কেন্দ্রে থাকে সমস্যার সমাধানমুখী প্রক্রিয়া। সমস্যার মূল কারণ অনুসন্ধান করতে এবং সে অনুযায়ী কার্যকর সুপারিশ প্রদানে পক্ষগুলোর মধ্যকার গবেষক ও মধ্যস্থতাকারীরা সহায়তা করেন। যেমনঃ শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন নরওয়ের গবেষকরা তামিল ও সরকারি প্রতিনিধিদের নিয়ে যে অনানুষ্ঠানিক কর্মশালা আয়োজন করেছিলেন, তা এই ধারার একটি উদাহরণ।
ছ. গোপন যোগাযোগ চ্যানেল চালু রাখাঃ অনেক সময় Track II কূটনীতিকে “back-channel diplomacy” বলা হয়। এটি এমন এক যোগাযোগমাধ্যম যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সরাসরি জড়িত না থেকেও আলোচনার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারে। যেমনঃ ১৯৬২ সালে কিউবান মিসাইল সংকট চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে গোপন অনানুষ্ঠানিক বৈঠকগুলি হয়, তা প্রধানত Track II কূটনীতির অংশ ছিলো।
Track I Diplomacy I ও Track II Diplomacy এর মধ্যকার পার্থক্যঃ
Track I Diplomacy ও Track II Diplomacy নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে দুর্বোধ্যতা দেখা যায়। ফলে, কূটনীতির এই প্রকার দুটির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় আমাদের জন্য খুব জরুরি।
Track II Diplomacy এর উদ্দেশ্যঃ
ক. Track II কূটনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বন্দ্বপূর্ণ পক্ষগুলির মধ্যে পারস্পারিক আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করা। আনুষ্ঠানিক আলোচনায় রাজনৈতিক চাপ থাকলেও, Track II কূটনীতি রাষ্ট্রকে একটি নিরাপদ প্লাটফর্ম প্রদান করে যেখানে অংশগ্রহণকারীরা খোলামেলা মত বিনিময় করতে পারেন।
খ. আনুষ্ঠানিক আলোচনায় অনেক সময় দ্বন্দ্বের “অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান” আলোচনার বাইরে থাকে। Track II সংলাপে গবেষক ও নাগরিক সমাজ ঐতিহাসিক, জাতীয় পরিচিতি এবং আর্থ-সামাজিক প্রভৃতি প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সংকটের অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন।
গ. Track II অংশগ্রহণকারীরা কোন সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে না, ফলে তারা কোন আইনি কাঠামোয় সরাসরি সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তবে তারা সরকারকে প্রয়োজনীয় নীতি সুপারিশ করতে পারেন যা সরকারের জন্য অত্র আইনি কাঠামোয় (চুক্তি, কনভেনশন, বৈদেশিক নীতি ইত্যাদি) যুক্ত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করে।
ঘ. Track II কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য আলোচনায় সমাজের বিভিন্ন অংশীজনের মতামতকে অন্তর্ভুক্ত করা। যেমনঃ এনজিও, ধর্মীয় নেতা, ব্যবসায়ী, নারী সংগঠন, এবং যুবসমাজ। এর ফলে আলোচনায় প্রান্তীক অংশের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। যেমনঃ আফ্রিকার Liberia peace process–এ নারী সংগঠন ও নাগরিক সমাজ Track II পর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, যা আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তি সফল করতে সহায়তা করে।
ঙ. Track II অনেক সময়কে বলা হয় policy incubator বা ideas laboratory। এটি সরকারি কূটনীতির জন্য নতুন চিন্তা–ভাবনা ও প্রস্তাবনার উৎস। এটি সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্র প্রস্তুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে নীতি–নির্ধারকরা সরাসরি রাজনৈতিক ঝুঁকি না নিয়েও বিকল্প সমাধানগুলো যাচাই করতে পারেন।
বিশ্ব রাজনীতিতে Track I Diplomacy এর ব্যবহারঃ
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক নতুন বহুমুখী বা multipolar আন্তর্জাতিক সিস্টেমে মোড় নেয়, যেখানে কেবল দুটি পরাশক্তির (আমেরিকা ও সোভিয়েত) ভারসাম্যের বদলে আঞ্চলিক শক্তি ও সংঘাতগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক জটিল সংঘাত দেখা দেয়। এই জটিলতা বিবেচনায় আশীর্বাদ স্বরূপ Track II কূটনীতির সূচনা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল–প্যালেস্টাইন বিরোধ নিরসনে ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই চুক্তি মূলত নরওয়েতে অনুষ্ঠিত Track II পর্যায়ের গোপন আলোচনার (back-channel diplomacy) মাধ্যমে শুরু হয়, যেখানে সরকারি প্রতিনিধি না থাকলেও নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞরা আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন; পরে সেটিই আনুষ্ঠানিক চুক্তির ভিত্তি হয়ে ওঠে। একইভাবে, ১৯৯০–এর দশকে বালকান অঞ্চলের Bosnia Conflict–এ Dayton Accord স্বাক্ষরের আগে মার্কিন ও ইউরোপীয় গবেষকরা Track II পর্যায়ে সার্ব, ক্রোয়াট ও বসনিয়ান নেতাদের মধ্যে একাধিক সমস্যা সমাধানমূখী আলোচনা সভার আয়োজন করেন।
কাশ্মীর ইস্যু, সীমান্ত সমস্যা, পানি বন্টন এবং পারমাণবিক উত্তেজনা ইত্যাদি দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার জটিল রাজনৈতিক সংকটের–এর কেন্দ্রবিন্দু। Track I কূটনীতি বারবার ব্যর্থ হলেও Track II কূটনীতি এই সংকট হয়তো এখনো সমাধান করতে পারেনি, তবে পারস্পারিক আস্থা বিনির্মাণে চেষ্টা চালাচ্ছে। এর কতিপয় উদাহরণ হলঃ Neemrana Dialogue যা ১৯৯০ থেকে এখনো চলমান। এটি ভারত–পাকিস্তান Track II সংলাপের সবচেয়ে পরিচিত প্ল্যাটফর্ম। এতে অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও গবেষকরা নিয়মিত অংশ নেন। PAK–India Nuclear Dialogue বিভিন্ন think tank (যেমন USIP, Carnegie Endowment) এর সহায়তায় দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা পারমাণবিক নীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। যদিও এসব উদ্যোগে সরাসরি কোন সমাধান আসেনি, তবে তারা আস্থা ও বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আফ্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে গৃহযুদ্ধ ও জাতিগত সংঘাত চলেছে, যেখানে Track I প্রক্রিয়া প্রায়শই ব্যর্থ হয়। Track II কূটনীতি আফ্রিকার সংকট সমাধানে বিকল্প শান্তি–উদ্যোগ হিসেবে কাজ করেছে। যেমনঃ বুরুন্ডিতে গৃহযুদ্ধ চলাকালে নাগরিক সমাজ ও চার্চের নেতারা মধ্যস্থতা করেছেন, যা Track I আলোচনাকে সম্ভব করেছে। সুদানে উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে শান্তি আলোচনায় আঞ্চলিক এনজিও ও চার্চ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা ২০০৫ সালের Comprehensive Peace Agreement–এর প্রস্তুতিমূলক ধাপ হিসেবে বিবেচিত। যদিও সুদান এখন পুনরায় অশান্ত। লাইব্রেরিয়াতে Women of Liberia Mass Action for Peace (একটি স্থানীয় আলোচনা পদক্ষেপ) Track II পর্যায়ে ভূমিকা রাখে, যার ফলে ২০০৩ সালে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আফ্রিকায় চলমান সংঘাতে Track II কূটনীতি অধিকাংশ সময় “bottom-up peacebuilding” প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে।
উত্তর আয়ারল্যান্ডে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত (The Troubles) শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছায় Good Friday Agreement (1998)–এর মাধ্যমে। এর আগে একাধিক Track II সংলাপ হয় চার্চ, স্থানীয় নেতৃত্ব, একাডেমিক ও এনজিও এর মধ্যে, যা পারস্পারিক আস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। আবার উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে পরমাণু ইস্যু ও নিরাপত্তা উত্তেজনা প্রশমনে Track II পর্যায়ের সংলাপ (যেমন Korean Peninsula Energy Development Organization – KEDO–র অনানুষ্ঠানিক বিশেষজ্ঞ বৈঠক) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক পালন করেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে Track II Diplomacyঃ ভূ-কৌশলগত দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর চারপাশে রয়েছে ভারত, মিয়ানমার এবং বঙ্গোপসাগর। পাশাপাশি দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে এর রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। এসব ভূ–রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য কূটনীতি কেবল Track I বা সরকারকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিক পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং Track II বা অ–সরকারি পর্যায়ের সংলাপও বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে। নাগরিক সমাজ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, একাডেমিক ও আন্তর্জাতিক এনজিও–র মাধ্যমে পরিচালিত Track II কূটনীতি বাংলাদেশের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশেষত যেখানে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা বা আনুষ্ঠানিক জটিলতার কারণে সমাধান ধীরগতির হয়ে পড়ে, সেখানে Track II কূটনীতি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের কূটনীতির প্রয়োগ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে লক্ষ্য করা যায়।
প্রথমত, বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ হলেও একাধিক জটিল ইস্যুর কারণে তা অনেক সময় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত সমস্যা (যেমন ছিটমহল বিনিময়, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড) এবং বাণিজ্য ঘাটতি ইত্যাদি বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় রাজনৈতিক চাপ ও সংবেদনশীলতার কারণে সমঝোতা অর্জন কঠিন হয়ে ওঠে। এখানে Track II কূটনীতি ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ–ভারতের গবেষণা ফোরামের যৌথ আলোচনায় আস্থা গঠনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যদিও এখনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। তবু এ ধরনের সংলাপ দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বোঝাপড়া বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ–মিয়ানমার সম্পর্ক মূলত রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অনমনীয় অবস্থান ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে Track I কূটনীতি জটিল হয়ে পড়েছে। এখানে Track II কূটনীতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন, আন্তর্জাতিক এনজিও ও একাডেমিকেরা এ বিষয়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে জনমত গঠনে কাজ করছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের থিঙ্ক–ট্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ policy dialogue জাতিসংঘ ও আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনার ভিত্তি তৈরি করেছে। যদিও সেখান থেকে তাৎক্ষণিক সমাধান আসেনি, তবে রোহিঙ্গা সংকটকে আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় ধরে রাখতে Track II কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
তৃতীয়ত, বঙ্গোপসাগরীয় নিরাপত্তা বাংলাদেশের জন্য ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাংলাদেশ এখন সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সামুদ্রিক সহযোগিতা এবং ব্লু ইকোনোমিকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। Track II পর্যায়ে BIMSTEC, IORA ও Indian Ocean Dialogue–এর মতো ফোরামে বাংলাদেশের গবেষক, একাডেমিক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন। এসব আলোচনায় সমুদ্র কেন্দ্রিক অপরাধ প্রতিরোধ, মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও আঞ্চলিক অবকাঠামো উন্নয়নের মতো বিষয় আলোচিত হয়। এভাবে Track II কূটনীতি নৌ–নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।
চতুর্থত, জলবায়ু পরিবর্তন কূটনীতি বাংলাদেশের জন্য অন্যতম অগ্রাধিকার। বিশ্বে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি হওয়ায় বাংলাদেশকে প্রায়শই বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় (যেমন COP summits) রাজনৈতিক বিতর্ক ও অর্থায়ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সেক্ষেত্রে Track II কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিকল্প কৌশল প্রস্তাব করে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ–ভারত–নেপাল–ভুটান নাগরিক সমাজের সংলাপে জলবায়ু অভিযোজন (climate adaptation) ও আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনায় যৌথ সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে, যা আঞ্চলিক সমন্বয় জোরদারে সহায়ক।
অবশেষে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটেও Track II কূটনীতির ভূমিকা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি (১৯৯৭)–এর মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের আনুষ্ঠানিক সমাধান হলেও টেকসই শান্তির ক্ষেত্রে এখনো নানা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এখানে স্থানীয় এনজিও, সম্প্রদায়ভিত্তিক সংগঠন ও একাডেমিকরা Track II পর্যায়ে কাজ করছে, যা শান্তি প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি আস্থা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া গঠনে ভূমিকা রাখছে।
Track II Diplomacy এর সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা
Track II Diplomacy কোনো আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় ম্যান্ডেট বহন করে না। ফলে এর আলোচনায় প্রস্তাবিত সমাধান বা সুপারিশ বাধ্যতামূলক নয়। সরকার চাইলে তা গ্রহণ করতে পারে, নাও করতে পারে।
অধিকাংশ Track II উদ্যোগ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বা বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে কখনো কখনো আলোচনার দিকনির্দেশনা দাতাদের রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
অনেক সময় Track II আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা সমাজের সাধারণ জনগণ বা মূলধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলিকে প্রতিফলিত করেন না। এর ফলে প্রস্তাবিত সমাধান মাঠপর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
কিছু সরকার Track II কূটনীতিকে সন্দেহের চোখে দেখে। অনেক সময় এটি সরকারি নীতির বিকল্প বা বিরোধী মত হিসেবে দেখা হয়, ফলে অংশগ্রহণকারীরা রাজনৈতিক চাপ বা প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েন।
Track II কূটনীতি দীর্ঘমেয়াদি আস্থা গঠন ও ধাপে ধাপে সমাধানমুখী আলোচনার ওপর নির্ভরশীল। তাই দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায় না, বিশেষ করে যখন সংঘাত গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
Track 1.5 Diplomacyঃ কূটনীতির সমন্বিত রূপ
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কূটনীতি মূলত দুই ধারায় বিকশিত হয়েছঃ রাষ্ট্র–রাষ্ট্র সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া বা Track I Diplomacy এবং নাগরিক সমাজ বা অনানুষ্ঠানিক অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে পরিচালিত Track II Diplomacy। তবে বিশ শতকের শেষভাগ থেকে বৈশ্বিক রাজনীতি ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠে এবং রাষ্ট্রীয় সীমারেখা অতিক্রম করে আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করে। গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে, শুধু Track I বা Track II আলাদাভাবে সংঘাত নিরসন বা আস্থা গঠনে যথেষ্ট নয়। এই প্রেক্ষাপটে Track 1.5 Diplomacy বা সমন্বিত কূটনীতির ধারণার উদ্ভব ঘটে। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে সরকারি প্রতিনিধি ও বেসরকারি অংশগ্রহণকারীরা একই আলোচনায় যুক্ত হন। একদিকে এখানে আনুষ্ঠানিক কূটনীতির বৈধতা ও কর্তৃত্ব থাকে, অন্যদিকে Track II–এর মতো নমনীয়তা ও মুক্ত আলোচনার পরিবেশ বজায় থাকে। ফলে Track 1.5 আধুনিক কূটনীতিতে এক নতুন ধারার সূচনা করেছে।
Track 1.5 Diplomacy–কে গবেষকরা “অনানুষ্ঠানিক–আনুষ্ঠানিক সংলাপ প্রক্রিয়া” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন, যেখানে রাষ্ট্র এবং অ-রাষ্ট্রীয় কর্মক/ সত্ত্বা একই প্ল্যাটফর্মে মতবিনিময় করেন। মার্কিন কূটনীতিবিদ Joseph Montville একে “bridge-building diplomacy (সেতুবন্ধনের কূটনীতি)” বলেছেন, কারণ এটি রাষ্ট্রীয় ও অ–রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণকারীর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। এর সমন্বিত রূপের কারণে Track I এবং Track II উভয়ের উপাদান এখানে বিরাজ করে। আলোচনায় সরকারি প্রতিনিধি যেমন থাকেন, তেমনি গবেষক, একাডেমিক, প্রাক্তন কূটনীতিক, থিঙ্ক–ট্যাঙ্ক বা এনজিও–র প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। এর ফলে এটি এক ধরনের অর্ধ–আনুষ্ঠানিক পরিবেশ তৈরি করে যেখানে কঠোর প্রটোকলের বাইরে গিয়ে মুক্ত মতবিনিময়ের সুযোগ থাকে, আবার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে গোপনীয়তাও বজায় রাখা যায়।
Track 1.5 Diplomacy এর অন্যতম বৈশিষ্ট্যটি হলো সংলাপের সুযোগ নীতি। সরকারি প্রতিনিধিরা নাগরিক সমাজ ও গবেষকদের কাছ থেকে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি শুনতে পারেন এবং এসব মতামত নীতি প্রণয়নে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। একইসাথে এটি আস্থা গঠনে কার্যকর, কারণ অনেক সময় সরকারি প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় কিছু ইস্যু তোলা যায় না, অথচ Track 1.5–এর অনানুষ্ঠানিক আবহে প্রাথমিক মতবিনিময় সম্ভব হয়। ফলে এটি নীতি–প্রক্রিয়ার জন্য “political space” তৈরি করতে সাহায্য করে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে Track 1.5 Diplomacy–এর প্রয়োগ বহুবার দেখা গেছে। এ ধরনের কূটনীতির সুবিধা হলো এটি সরাসরি নীতি–নির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে। Track II–এর মতো কেবল সুপারিশ নয়, বরং সরকারি প্রতিনিধিদের উপস্থিতির কারণে এসব আলোচনার ফলাফল দ্রুত নীতি প্রণয়নে প্রতিফলিত হতে পারে। এছাড়া পারস্পারিক বোঝাপড়া ও আস্থা গঠনে এর কার্যকারিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের একসাথে বসানো হলে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আস্থা বৃদ্ধি পায়। Track I–এর বৈধতা ও Track II–এর সৃজনশীলতার সমন্বয় ঘটিয়ে এটি বাস্তবসম্মত সমাধানের সম্ভাবনা তৈরি করে। একইসাথে সরকারি নিরাপত্তা স্বার্থ ও নাগরিক সমাজের মানবিক চাহিদা একসাথে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়, যা একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।
তবে Track 1.5 Diplomacy এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সীমাবদ্ধতা হল এর অস্পষ্টতা। Track 1.5 আলোচনায় কোনো সরকারি প্রতিনিধি কি ব্যক্তিগত মতামত দিচ্ছেন নাকি রাষ্ট্রীয় অবস্থান প্রকাশ করছেন তা অনেক সময় পরিষ্কার নয়। এর ফলে রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হয় এবং কিছু রাষ্ট্র এসব উদ্যোগকে “অপচেষ্টা” বা “অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ” হিসেবে দেখতে পারে। অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীলতাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ অধিকাংশ Track 1.5 ফোরাম আন্তর্জাতিক দাতা বা সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত হয়, যা টেকসই নয়। একইসাথে প্রতিনিধিত্বের সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়, কারণ সবসময় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মতামত প্রতিফলিত করতে সক্ষম হন না।
উপসংহার
Track II Diplomacy আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এটি রাষ্ট্রীয় কূটনীতির বিকল্প নয় বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে পারস্পারিক আস্থা গঠন, যোগাযোগ বৃদ্ধি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য এর ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল ও সংকট প্রবণ দেশগুলোর জন্য Track II Diplomacy বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় Track II Diplomacy এক জরুরি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে, যা নাগরিক সমাজ, একাডেমিক ও নীতি–নির্ধারককে একই সুতোয় গেঁথে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সহায়তা করে।


No comments