জলবায়ু নেতৃত্বে বাংলাদেশ: কূটনীতির নতুন দিগন্ত | Climate Diplomacy of Bangladesh
![]() |
| Climate Diplomacy |
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরূপ প্রভাব যে শুধু পরিসংখ্যানের বিষয় নয় তার জীবন্ত প্রমাণ বাংলাদেশ। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুসারে শতাব্দীর শেষ ভাগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই অঞ্চলের প্রায় ১৭ শতাংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে, যার ফলে প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতির সম্ভবনা রয়েছে। আর তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন এখন কেবল পরিবেশগত ইস্যু নয় বরং পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কারণ জলবায়ু সংকট যে শুধু প্রকৃতির ক্ষতি করছে তা নয় সেই সাথে দেশের অর্থনীতি, মানবাধিকার এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে গভীর ভাবে প্রভাব ফেলছে।
তবে এই হুমকির মুখোমুখি হয়েও বাংলাদেশ যে শুধু প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে থেমে আছে তা নয় বরং সক্রিয়ভাবে বৈশ্বিক জলবায়ু কূটনীতিতে একটি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশ যে শুধু একটি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ তা নয় বরং জলবায়ু ন্যায্যতা, অভিযোজন এবং ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের জন্য একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। মূলত জলবায়ু কূটনীতি হলো বিশ্বের দেশসমূহ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আলোচনা, চুক্তি ও সহযোগিতার একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। এর উদ্দেশ্য পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, খাদ্য ও পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম করা। এই কূটনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ আজ বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করছে।
জলবায়ু কূটনীতিতে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক নেতৃত্ব
জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় উদীয়মান নেতৃত্বের প্রতীক বাংলাদেশ বর্তমানে বহুপাক্ষিক, দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে তার কূটনৈতিক সক্ষমতার চমকপ্রদ প্রদর্শন করে চলেছে। এই সক্ষমতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী ও সক্রিয় লবিং কার্যক্রম। কপ-১৫ থেকে শুরু করে কপ-২৭ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চালানো এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি হিসেবে কপ-২৭-এ ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যা বাংলাদেশের বৈশ্বিক জলবায়ু কূটনীতিতে একটি যুগান্তকারী অর্জন হিসেবে স্বীকৃত।
বহুপাক্ষিকতার এই পথচলা শুধু জলবায়ু সম্মেলনেই সীমাবদ্ধ নেই বরং এলডিসি দেশগুলোর সমন্বিত গ্রুপ এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) এর মতো ফোরামেও বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যন্ত সক্রিয়। ২০২০-২০২২ সাল নাগাদ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের চেয়ারম্যান পদে বাংলাদেশের দায়িত্ব পালন ছিল অন্যতম মাইলফলক। এই নেতৃত্বদানকালীন সময়ে বাংলাদেশ উপস্থাপন করে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপেরিটি প্ল্যান’ যা জলবায়ু সহনশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে একটি গতিশীল সেতুবন্ধন তৈরি করে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এক অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
এছাড়া বহুপাক্ষিক ফোরামের পাশাপাশি দেশটি সমান্তরালভাবে দ্বিপাক্ষিক পর্যায়েও তার নেতৃত্ব ও উদ্যোগের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনকে পররাষ্ট্রনীতির একটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিটি কৌশলগত অংশীদার রাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে তুলেছে। এই সহযোগিতাগুলো তহবিল বা প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি জ্ঞান, প্রযুক্তি, অভিজ্ঞতা এবং নীতিগত অবস্থান বিনিময়ের ক্ষেত্রে একটি বিস্তৃত কাঠামো গড়তে সাহায্য করছে। আর এই যাত্রায় বাংলাদেশের সাথে হাত মেলিয়েছে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তিগুলো। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘ইউএস-বাংলাদেশ ক্লাইমেট পার্টনারশিপ (২০২১)’ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানি, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ‘গ্রিন ট্রানজিশন’ সহযোগিতা চুক্তি আমাদের কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন ও টেকসই বিনিয়োগের পথকে আরও সুগম করেছে।
অন্যদিকে প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর প্রতিবেশী দেশ জাপানের সাথে গড়ে উঠেছে ‘বাংলাদেশ-জাপান ক্লাইমেট অ্যান্ড এনার্জি পার্টনারশিপ’। এই অংশীদারিত্বগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। সেই সাথে চীনের বিশাল ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’ কাঠামোর মধ্যেও বাংলাদেশ সক্রিয়তার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে সবুজ অবকাঠামো বিনিয়োগ ও জলবায়ু প্রযুক্তি স্থানান্তরের বিষয়টিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে।
বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মতো প্রচলিত উৎসের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরাসরি ‘গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ)’ এর সাথেও তার যোগাযোগ শক্তিশালী করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে, জলবায়ু-সহিষ্ণু অবকাঠামো তহবিলসহ ১০টিরও বেশি অত্যাবশ্যকীয় প্রকল্পের জন্য ইতোমধ্যে অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার অঙ্গনেও বাংলাদেশ জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় তার দূরদর্শী নেতৃত্বের পরিচয় দিয়ে আসছে। এই অগ্রযাত্রার সূচনা হয়েছিল মূলত সার্ক (SAARC) এর মঞ্চে। ২০১০ সালের শীর্ষ সম্মেলনের মূল বিষয়বস্তুই ছিল ‘সবুজ ও সুখী দক্ষিণ এশিয়া’ গড়ে তোলা আর সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশই প্রথম প্রস্তাব করে একটি যুগান্তকারী আঞ্চলিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার। এটি ছিল একটি সম্মিলিত আঞ্চলিক সুরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলার প্রথম প্রস্তাব।
কেবল সার্কেই নয়, ‘বিমস্টেক’ (BIMSTEC) এর মতো বহুপাক্ষিক ফোরামেও বাংলাদেশ দৃঢ় কণ্ঠে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে । উপকূলীয় অঞ্চলের দুর্যোগ মোকাবিলার কৌশল, খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো ভবিষ্যতমুখী খাতে সহযোগিতার বিষয়গুলোকে বাংলাদেশ বারবার এজেন্ডার শীর্ষে স্থান দিয়েছে।
পাশাপাশি আসিয়ান (ASEAN) এর সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে সংলাপ জোরদার করছে, যেখানে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষুদ্র ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানো এবং প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে জলবায়ু ঝুঁকি হ্রাসের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। এই পারস্পরিক সহযোগিতা কেবল জলবায়ু সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করছে না, বরং ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক ও মানবিক নিরাপত্তার ভিত্তিও মজবুত করছে।
জলবায়ু কূটনীতিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও অভিযোজন ও নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশটির অর্জন উল্লেখযোগ্য। একটি সুসংহত নীতি কাঠামো গড়ে তোলা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা শক্তিশালীকরণ এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্রিয় ভূমিকা রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু কূটনীতিতে একটি কার্যকর অবস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে। এর মধ্যে রয়েছে,
১. সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের নিজস্ব রোডম্যাপ: এই অগ্রযাত্রার সূচনা ঘটে ২০০৯ সালে, যখন বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএপি) প্রণয়ন করে। এই কৌশলপত্রটি কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্যই একটি অগ্রণী উদ্যোগ ছিল, যেখানে জলবায়ু অভিযোজন, প্রশমন এবং সামগ্রিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটি সমন্বিত রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই উদ্যোগটি বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে, কারণ বিশ্বের খুব কম উন্নয়নশীল দেশই নিজস্ব সম্পদ ও পরিকল্পনা নিয়ে এতটা সুসংহত এবং ব্যাপক কাঠামো তৈরি করতে পেরেছে। নীতির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ছিল অনন্য। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) এ জাতীয় বাজেট থেকে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাগুলো এই তহবিলকে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, যা প্রমাণ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোও জলবায়ু অর্থায়নে আন্তরিকতা ও নেতৃত্ব প্রদর্শন করতে সক্ষম।
২. বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও নেতৃত্বের অভিযাত্রা: নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অঙ্গনে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করেছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি বাংলাদেশকে ‘চ্যাম্পিয়ন অফ দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এই সম্মাননা বাংলাদেশের সামগ্রিক জলবায়ু নীতির প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর আস্থা ও স্বীকৃতিরই প্রতিফলন। বৈশ্বিক নেতৃত্বের আরেকটি মাইলফলক স্থাপিত হয় ২০২০ সালে, যখন বাংলাদেশ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) এর সভাপতিত্ব গ্রহণ করে। এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশই বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করে ‘ঢাকা ঘোষণাপত্র’ (Dhaka-Glasgow Declaration)। যেখানে ৪৮টি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সমর্থন নিয়ে গৃহীত এই ঘোষণাপত্রে জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ মোকাবিলায় বিশেষ তহবিল গঠন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থান পায়।
৩.বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত ও বৈশ্বিক রোল মডেল: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো তাত্ত্বিক নীতি থেকে বাস্তব ক্ষেত্রে রূপান্তরের অসাধারণ সক্ষমতা। ‘স্থানীয়ভাবে নেতৃত্বাধীন অভিযোজন’ (Locally Led Adaptation - LLA) কৌশলটি এই সক্ষমতারই প্রতিফলন, যা আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ২০২১ সালে গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপ্টেশন এবং কপ-২৬ সম্মেলনে এই মডেলটি বৈশ্বিক স্বীকৃতি লাভ করে, যেখানে বাংলাদেশের স্থানীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক অভিযোজন পদ্ধতিকে বিশ্বব্যাপী প্রয়োগের তাগিদ দেওয়া হয়। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সোলার হোম সিস্টেম প্রকল্পটি একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এই উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের ৬০ লাখেরও বেশি পরিবার সৌরবিদ্যুতের সুবিধার আওতায় এসেছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপির মূল্যায়নে এটি ‘বিশ্বের বৃহত্তম অফ-গ্রিড নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি’ হিসেবে স্বীকৃত। নীতি, প্রতিষ্ঠান ও বাস্তবায়নের এই ত্রিমুখী সাফল্য বাংলাদেশকে কেবল আভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালীই করেনি, বরং তাকে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় একটি কার্যকর ও অনুসরণীয় মডেলে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশের জলবায়ু কূটনীতির মুখ্য চ্যালেঞ্জসমূহ
জলবায়ু কূটনীতিতে বাংলাদেশের সাফল্য যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনি এই অগ্রযাত্রায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও নেতৃত্বের অবস্থান সত্ত্বেও দেশটিকে এখনও মোকাবেলা করতে হচ্ছে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, অভ্যন্তরীণ সক্ষমতার ঘাটতি এবং নতুন নতুন ঝুঁকি। এসব চ্যালেঞ্জ কেবল বর্তমান অগ্রগতিকে প্রভাবিত করছে না, ভবিষ্যতের কূটনৈতিক কৌশলকেও নতুনভাবে রূপদানের প্রয়োজন তৈরি করছে। বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত তহবিল না পাওয়া। বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিলের প্রতিশ্রুতি এখনও বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অভিযোজন ও প্রশমন প্রকল্পগুলো ব্যাহত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ফোরামে নৈতিক দাবি উত্থাপন করতে পারলেও, বৃহৎ শক্তিগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের ফলে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর অনেক সময় পৌঁছায় না। অভ্যন্তরীণভাবে নীতি ও বাস্তবায়নের মধ্যে ব্যবধান একটি বড় সমস্যা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং স্থানীয় পর্যায়ে সক্ষমতার ঘাটতি থাকায় গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ মানবসম্পদ ও গবেষণাভিত্তিক তথ্যের অভাব রয়েছে। নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জলবায়ু-প্রবাসন সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য এখনও কোনো আন্তর্জাতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। অন্যদিকে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল প্রতিষ্ঠিত হলেও এর সুবিধা পাওয়ার পথ এখনও জটিল ও অনিশ্চিত।
সবমিলিয়ে, অর্থায়নের ঘাটতি, অভ্যন্তরীণ সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং নতুন ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এজন্য দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব জোরদার করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের জলবায়ু কূটনীতির সম্ভাবনা
ভবিষ্যতের জলবায়ু কূটনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে বাংলাদেশকে একটি কৌশলগত ও সমন্বিত পথ অবলম্বন করতে হবে। প্রথমত, বৈশ্বিক পর্যায়ে অন্যান্য জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সাথে কৌশলগত জোট গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা আন্তর্জাতিক আলোচনায় সম্মিলিত প্রভাবকে আরও জোরদার করবে। একইসাথে, জলবায়ু তহবিলে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল থেকে অর্থায়ন পাওয়ার জন্য সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো প্রয়োজন। জলবায়ু ইস্যুকে পররাষ্ট্রনীতির মূলধারায় সম্পৃক্ত করা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যাতে করে সকল দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাশ্চাত্য আলোচনায় এটি অগ্রাধিকার পায়।
এছাড়া বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তভিত্তিক অবস্থান নির্মাণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সর্বোপরি, স্থানীয়ভাবে নেতৃত্বাধীন অভিযোজন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো সফল মডেলগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরে বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় একটি অনুসরণীয় মডেল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এই সমন্বিত পদ্ধতি বাংলাদেশকে কেবলমাত্র একজন সক্রিয় অংশীদারই নয়, বরং বৈশ্বিক জলবায়ু শাসন ব্যবস্থার একজন অপরিহার্য রূপকার হিসেবে গড়ে তুলবে।
-
শমরিতা বড়ুয়া, শিক্ষার্থী,
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


No comments