যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগ ও আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ
সাম্প্রতিক সময়ের কিছু আগেই- অর্থাৎ বারাক ওবামার দ্বিতীয় প্রসিডেন্সির একদম শেষের দিকে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদদের লেখনি এবং আলোচনায় উঠে আসছিল যে আসন্ন দিনগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, বিশেষত সাংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলো থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি বেশি নজরে এসেছে। এই সুত্রকে নির্বাচনী ইশতেহারে জায়গা করে দিয়ে ২০১৬ র নির্বাচনে বিজয়ী হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতায় বসে অনেক কিছুই ওলটপালট করেছেন ট্রাম্প, পাশাপাশি মার্কিন সৈন্য ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের ক্ষেত্রটিও অনেকাংশে ট্রাম্প প্রস্তুত করে গেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন তালেবানদের সাথে শান্তি চুক্তি করার মাধ্যমে মার্কিন সৈন্যদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার চূড়ান্ত প্রস্তাবণা প্রদান করেছেন।
বাইডেনের ঘোষনা মতে, যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছরের ১১ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে সকল মার্কিন সৈন্যকে আফগানিস্তান থেকে নিরাপদে সরিয়ে নিবেন। তার এই বক্তব্যের বিপক্ষে প্রতিপক্ষ তালেবানরা তীব্র প্রতিবাদ প্রকাশ করেছেন এবং তারা অতিসত্বর আফগান ভূমি হতে সকল বিদেশী সৈন্যকে সরিয়ে নেয়ার হুমকিও দিয়েছেন। অন্যদিকে বাইডেনের এই সিদ্বান্তে আফগানিস্তানের মানবাধিকার রক্ষা কর্মীরা দারুন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন, এবং আশরাফ ঘানির সরকারি দল একটা অনিশ্চিয়তার মধ্যে পরে গেছেন। যাইহোক, আজকের আলোচনায় আমরা দেখানোর চেষ্টা করবো কোন প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল, আবার কেনোই বা সেখান থেকে প্রত্যাহার ঘটাচ্ছে? এবং মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ফলে আফগানিস্তানে স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন কেমন প্রভাব পরতে পারে?
মার্কিনীদের আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ কিভাবে শুরু হয়েছিল?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছুই জানা আছে। ৯/১১ পরবর্তী “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” ঘোষণা করে প্রথমে আফগানিস্তানে পরে ইরাকে অনুপ্রবেশ এবং সেখান থেকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভুত্ব বিস্তার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ খুব ভালোভাবেই আদায় করেছেন। যাইহোক, এক্ষেত্রে আমাদের আলোচনার জায়গাটা হবে একটু ভিন্ন, অর্থাৎ যে নীতি বা মতবাদকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানে আসা -সেই “বুশ ডক্ট্রিন” নিয়ে কিছু কথা আমরা বলব।
বুশ ডক্ট্রিন ছিল ৯/১১ প্রেক্ষাপটে নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি উগ্রবাদী বৈদেশিক মতবাদ। এই ডক্ট্রিনের মাধ্যমে বুশ প্রশাসন এরূপ একটি পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হন যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোন আক্রমণাত্মক একশন নিতে পারবে । এই মতবাদটি প্রধানত ৪টি পয়েন্টকে সামনে রেখে তৈরি করা হয়। যথাঃ
গণতন্ত্রের বিকাশ,
সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাট্
একমেরু কেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা তৈরি, এবং
যুক্তরাষ্ট্রের হেজেমনি পূনঃপ্রতিষ্ঠা।
এই মতবাদে প্রথমত কিছু রাষ্ট্রকে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিপক্ষ এবং পরবর্তী তার শক্তিশালী মিডিয়ার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে, এবং এই জোটটাকে “শয়তানের আখড়া” বা “Axis of Evil” হিসেবে আখ্যা দেন। এই লিস্টে রয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, উত্তর কোরিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া এবং কিউবা। ডাব্লিউ বুশ দেশব্যাপী প্রচারণা চালান যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো বাদেও এই সকল রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। বুশ প্রশাসনের মতে এদের সামাজিক বিকৃতিকে যতক্ষণ না সুশীল পর্যায়ে আনা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। এক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তন অর্জন শুধু গণতন্ত্রায়ণের মাধ্যমেই সম্ভব, এবং এই রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতাসীনরা কিন্তু চরম গণতন্ত্রবিরোধী এবং একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী। ফলে আফগানিস্তান সহ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর শাসকদের ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্ন করতে থাকেন, এবং আমরা দেখি বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি সংঘাতপূর্ণ দেশেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নাম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দখলদারিত্ব চালাচ্ছে।
আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র খুব সহজেই সেই গনতন্ত্র বিরোধী ট্যাগটা দিতে সক্ষম হন, এবং সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া দেশব্যাপী ব্যাপক তালেবান বিরোধী প্রচারণা চালায়। এই প্রচারণার সবচেয়ে বড় অংশ জুরে ছিলো তালেবান সরকারের আল-কায়েদা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দান। আপনারা যদি মাইকেল মুরের “Fahrenheit 9/11” ডকুমেন্টারিটা দেখেন, আপনারা খুব সহজেই ধরতে পারবেন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে দেশব্যাপী আফগানিস্তানে হামলার প্লটটি সৃষ্টি করেছিলো, এমনকি রিপাবলিক ও ডেমোক্রাট উভয়ের সম্মতিতেই যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল।
যাইহোক, আফগানিস্তান দখলের পর তালেবান সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনের অভিযোগ এনে তাকে সরিয়ে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত আশরাফ ঘানি সরকারকে অধিষ্ঠিত করা হয়। পাশাপাশি, কোনরূপ জাতিসংঘের ম্যান্ডেট ছাড়াই অন্য একটি রাষ্ট্রকে দখল করে নেয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যবস্থাকে একপাক্ষিক (Unilateralism) ভাবে সাজানোর প্রতিজ্ঞা নেয় যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘদিনের হেজমনিক শক্তিকে যথেচ্ছা ব্যবহার করতে পারবে। মজার বিষয়, এই কথাগুলো ৯/১১ পরবর্তী শোকাহোত ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মার্কিনীদের খুব মনে ধরতেছিলো, এবং যেকোনো মূল্যেই তারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বুশ প্রশাসনকে চাপ দিতে থাকেন, এবং ডাব্লিউ বুশ এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ ঘটান।
অতএব আপনারা বুঝতেই পারছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মত একটি নাগরিক রাষ্ট্রে যেখানে কোন আইন পাশে জনগণের সমর্থন দরকার পরে, সেখানে এই মতবাদটি কত সুচারুভাবেই না বুশ প্রশাসনকে তাদের লক্ষ্যে পৌছাতে সহায়তা করেছে- অর্থাৎ, এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্য বিস্তার করা।
যুক্তরাষ্ট্র কেন মধ্যপ্রাচ্য নীতি থেকে সরে যাচ্ছেঃ
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারকে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি থেকে সরে আসার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। এই প্রত্যাহারের পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে বলে আমি মনে করি। আমি ব্যাক্তিগতভাবে কিছু কারণ নির্ধারণের চেষ্টা করেছি যার সাথে হয়তো আপনাদের অনেকের নাও মিলতে পারে। আশাকরি, আপনারা কমেন্টে কিছু যুক্ত করবেন।
যাইহোক, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি সবসময়ই কিছু নির্দিষ্ট প্রেসিডেন্সিকে ঘিরে আবর্তিত হয়, অনেকটা প্রি-প্লানড ভাবে চলে। যখন সংঘাত বা যুদ্ধের কথা বলি, তাও এই ধারাবাহিকতাকে কেন্দ্র করে চলেছে। যেমন ধরুন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা। সংঘাতটা শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্স আইজেনহাওয়ারের সময়। সেই যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যায় যখন ক্ষমতায় আসে জন এফ কেনেডী এবং জনসন। এই দুই রাষ্ট্রপতি ভিয়েতনাম যুদ্ধকে একদম তীব্র পর্যায়ে নিয়ে যান। মজার ব্যপার হল, এই রাষ্ট্রপতিরা ক্ষমতায় এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের হেজমনিক শক্তিকে বিশ্বের সামনে শক্তভাবে প্রকাশ করার নির্বাচনী ম্যান্ডেট নিয়ে। পরবর্তীতে যখন দেশব্যাপী যুদ্ধের বিপরীতে ব্যপক আন্দোলন সৃষ্টি হয় সেই সুযোগটা গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ক্ষমতায় আসেন।
এখন আপনি যদি, এই উদাহরণের সাথে বর্তমানে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ ও প্রত্যাহারকে মিলান তাহলে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাথে একটা স্বাভাবিক প্যাটার্ন আপনারা দেখতে পারবেন। ভিয়েতনামের মত- আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন সৈন্যের অনুপ্রবেশ ঘটাতে সাহায্য করে জর্জ ডাব্লিউ বুশ, পরবর্তীতে বারাক ওবামা ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধটাকে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দেন, এবং সিরিয়া, ইয়ামেন ও লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অনুপ্রবেশ ঘটান, পরবর্তীতে যখন যুক্তরাষ্ট্রে আবার যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, তখন এই শ্লোগানকে পুজি করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসেন,এবং তিনি সৈন্য প্রত্যাহারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। অবশেষে, জো বাইডেন এসে মূলত ট্রাম্পের অপূর্ণ কাজটিকে পূর্ণ করতে যাচ্ছেন। হয়তো ভবিষ্যতে এমন কোন যুদ্ধ আপনারা দেখতে পারবেন যেখানে যুক্তরাষ্ট্র অংশ নিয়েছে, এবং আপনারা তখন এই স্বাভাবিক প্যাটার্নটা সেখানে খুজে পাবেন। এই প্যাটার্নের পিছনে রয়েছে সামরিক স্বার্থের জটিল সমীকরণ (Military Industrial Complex)।
দ্বিতীয় যে কারণটি যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসার তা হতে পারে সংঘাত বা যুদ্ধের প্রকৃতির পরিবর্তন। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে যুদ্ধ প্রধানত দুই ধরণের, যথাঃ সামগ্রিক যুদ্ধ (Unlimited War) যেখানে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তার সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে যুদ্ধে জিততে বা টিকে থাকতে, এবং নির্দিষ্ট যুদ্ধ (Limited War) যেখানে কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দ্যেশকে সামনে রেখে নির্দিষ্ট বা স্বল্প পরিসরে সংঘাতে জড়ানো হয়। আফগানিস্তানে যখন ডাব্লিউ বুশ অনুপ্রবেশ করেন, তখন তিনি বুশ ডক্ট্রিনের মাত্র ৪ টি পয়েন্টকে সামনে নিয়ে এগোতে থাকেন। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ যে কোন নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না তা কিছুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারেন। পাশাপাশি ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার সংঘাতেও যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করেন তখন তাদের পূর্বের সীমিত নীতিতে অনেক পরিবর্তন আনতে হয়। এই নীতি খুব দ্রুতই পরিবর্তিত হচ্ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে। ফলে যে রাজনৈতিক স্বার্থের উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে ঘাঁটি গেরেছিলো তার অনেকাংশেই পূর্ণ হচ্ছিলো না। পাশাপাশি এই অঞ্চলে চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরানের মত শক্তিগুলোর উপস্থিতি বৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক বাধা সৃষ্টি করছে।
এই অঞ্চলে রাশিয়ার শক্তিশালী প্রবেশ, বিশেষত সিরিয়া গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিধিতে এক নতুন সমীকরণ তৈরী করেছে। যেভাবে পুতিন সিরিয়া যুদ্ধটির মোড় একাই ঘুরিয়ে দি্যেছে, যেভাবে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র বলয়ের বিপরীতে গিয়ে বাশার আল আসাদকে সমর্থন প্রদান করছে, তা অনেকাংশে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে রাশিয়ার অনেকদিনের চাহিদাকে পূরণে সহায়তা করতে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপ্রবেশকে প্রাথমিকভাবে ইয়ালতসীনের রাশিয়া মেনে নিলেও, পুতিন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই, যুক্তরাষ্ট্রের এই অবৈধ দখলদারিত্বকে বারবার হাইলাইট করার চেষ্টা করেছে। বর্তমানেও, রাশিয়া তালেবান সরকারের সাথে একমত হয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মার্কিন সৈন্যকে আফগানিস্তান ত্যাগের উপর জোর দিচ্ছেন। অতএব, এই ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র একটি আলাদা চাপের মধ্যে তার সিদ্বান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন, এবং অন্যদিকে পূর্ব শত্রু রাশিয়ার সাথে তালেবান সরকারের একটা সু-সম্পর্ক তৈরী হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান তথা মধ্যপ্রাচ্যে থেকে সরে আসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সরিয়ে নিয়ে আসা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা আসন্ন কয়েক দশক যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এগোবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে যখন হেজেমনিক অধিপতি হিসেবে আসীন হয়, তখন থেকেই তার প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা করে রাখতে কন্টেইনমেন্ট নীতিমালাকে অনুসরণ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধ কালে যেমন সোভিয়েতের বিস্তার রোধে এই পলিসিকে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রধান লক্ষ্য করে রেখেছিল, বর্তমান সময়ে গণচীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে আকস্মিক আবির্ভাবও মার্কিনীদের সেই একই পথে চলতে বাধ্য করছে। চীনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী বাড়লেও, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের হেজমন হিসেবে কিন্তু চীন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। ফলে, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ফিলিপাইন প্রভৃতি একটা কোনঠাসা অবস্থায় পরে গিয়েছে। সম্প্রতি কোয়াড নামে শক্তিশালী নৌ-নিরাপত্তা জোট গঠনের মাধ্যমে এই অঞ্চলে চীনের প্রতিপক্ষ ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে চীনের প্রভাব প্রশমনের চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র করছে।
এগুলো ছাড়াও, অন্য যে কারণটিকে প্রায় আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলোতে বারবার হাইলাইট করেছে তাহল দেশব্যাপী আফগান যুদ্ধ বিরোধী মনোভাব – পাশাপাশি মার্কিন সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি ও মানসিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে যাওয়া। আগেই বলেছি, দেশে আফগান যুদ্ধ বিরোধী মনোভাবকে পুজি করে ক্ষমতায় এসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার নির্বাচনী ইশতেহারের বড় অংশ জুরে ছিল মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিপরীতে কাজ করছে, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের লাভের তুলনায় ক্ষতির পরিসংখ্যানই বেশি এবং মার্কিন সৈন্যদের কিছু স্বার্থবাদী প্রতিষ্ঠানের মুনাফার জন্যই ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে, অধিকাংশ সৈনিকদের মানসিক অবস্থা প্রচন্ড খারাপ অবস্থায় রয়েছে। অনেক ডকুমেন্টারি পাওয়া যায় যেখানে সৈনিকদের আফগানিস্তানে তিক্ত অভিজ্ঞতার চিত্র ফুটে উঠেছে। সৈন্যরা বারবারই এই যুদ্ধকে একটি অসম সংঘাত বলেছেন- অর্থাৎ এর কোন ফলাফল নেই। ঠিক যেমনভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সৈনিকদের বাজে অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন সিনেমা তৈরি হয়েছে যেমন ফরেস্ট গাম। হয়তো দেখা যাবে কিছুদিন পর আফগান যুদ্ধের সৈনিকদের কথাগুলোও চিত্রায়িত হয়ে আমেরিকার Military Industrial Complex এর যথাযথ রূপ দেখতে পাওয়া যাবে।
মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার ও আফগানিস্তানঃ
যুক্তরাষ্ট্র যে সিদ্বান্ত নিয়েছে মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করবে, তার ফলে আফগানিস্তানে স্বল্প বা দীর্ঘকালীন কেমন প্রভাব পরতে পারে তা নিয়ে বিশ্ব মহলে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এই আলোচনার অনেকাংশ জুড়ে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার পর আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার ব্যবস্থার কি হবে? এক্ষেত্রে পেন্টাগনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে বর্তমানের যে সরকার রয়েছে সে অন্তর্বতীকালীন ক্ষমতায় থাকবে, এবং যুক্তরাষ্ট্র পূর্বের ন্যায় আফগানিস্তানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সকল ধরণের সহযোগিতাকে বজায় রাখবে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার ও সহযোগিতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতির সাথে সম্পূর্ণ একমত প্রকাশ করেছে আফগানিস্তানের বর্তমান আশরাফ ঘানির সরকার। ঘানি বলেছেন, দীর্ঘদিনের সংঘাত রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনীকে একটি দক্ষ ও কার্যকরি সেনাবাহিনীতে পরিণত করেছে, ফলে তারা আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিধানে যথেষ্ট পটু।
কিন্তু আশরাফ ঘানির এই জি হুজুর নীতির তীব্র সমালোচনা করছেন আফগানিস্তানের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তাদের মতে, এভাবে কোনরূপ শান্তি চুক্তি ও সাংবিধানিক নিরাপত্তা বাস্তবায়ন ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র তাদের সৈন্য সরিয়ে নিতে পারেনা। ফলে ভবিষ্যতে দেশে একটি গৃহযুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এছাড়াও, এই বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটেও তোলা হয়েছে, এবং কয়েকজন সিনেটোর কোনরূপ চুক্তি ছাড়া এই প্রত্যাহারকে যুক্তরাষ্ট্রের মানহানির সাথে তুলনা করছে। এদিকে, তালেবানরা বরাবরই বলে আসছে অতিসত্বর মার্কিন সৈন্য সহ অন্যান্য বিদেশি বাহিনীকেও আফগান ত্যাগ করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রস্থান না হলে তালেবান বড় ধরণের হামলার হুমকি প্রদান করেছেন। এক্ষেত্রে তালেবানরা ঘানির বাহিনীকে হাঁটিয়ে ক্ষমতা দখল করবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারনা, অন্যথায় একটা বড় আকারের গৃহযুদ্ধ তৈরি হতে পারে আফগানিস্তানে, এবং সেক্ষেত্রে তার দায়ভার অবশ্যই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে নিতে হবে।
অতএব, আমরা দেখতে পারছি যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ যতটা সহজে হয়েছিল তার হেজমনিক আধিপত্যের দরুন, বর্তমান বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থায়, যেখানে বিশ্বরাজনীতিতে অনেকগুলো শক্তির উত্থান হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান কিন্তু আর তত সহজ বা তার ইচ্ছাধীন হতে পারছে না। সকলেই কিন্তু কোন ধরণের শান্তি চুক্তি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানকে সমালোচনার নজরে দেখবে, আর যদি সেখানে কোন রূপ মহামারী বা গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে জবাবদিহিতার একটা জায়গা তৈরি হতে পারে। যাইহোক, আমাদের পরের আলোচনায় আমরা যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রত্যাহার মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে তা দেখার চেষ্টা করবো।
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়






No comments