শিল্প বিপ্লবের নানা কথা
শিল্পবিপ্লব প্রত্যয়টি দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। উৎপত্তিগত অর্থে ল্যাটিন শব্দ “Industria” থেকে “Industry “ যার অর্থ দক্ষতা, যোগ্যতা ও সমৃদ্ধশালী হওয়া। আর “Revolution” বা বিপ্লব হলো কোন প্রচলিত ব্যবস্থার আকস্মিক আমুল ও দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হওয়া যে পরিবর্তন দীর্ঘকাল ব্যাপী স্থায়ী হয় ও যার প্রভাবে আর্থ-সামাজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়।
আঠারো শতকের শেষার্ধে ইংল্যান্ডে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার ও ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থায় যে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছিল তাকেই সাধারণ অর্থে শিল্পবিপ্লব বলা হয়। ১৮৩৭ সালে শিল্পবিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি সমাজতান্ত্রিক লেখক জেরেমি ব্লাংকি। পরবর্তীতে শিল্পবিপ্লব প্রত্যয়টি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবী তাঁর অক্সফোর্ডে দেওয়া বক্তৃতামালায় প্রথম উচ্চারণ করেন এবং ১৮৮৪ সালে তাঁর লেখা “Lectures on the Industrial Revolution in England “ গ্রন্থ প্রকাশিত হলে বিপ্লব ধারণাটির ব্যাপক প্রসার ঘটে।
▶️শিল্পবিপ্লবঃ ১৭৬০ সাল থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ইংল্যান্ড এবং পরে অন্যান্য দেশে উৎপাদন ব্যবস্থায় অর্থাৎ ইংল্যান্ডে প্রযুক্তি, জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রয়োগ পদ্ধতিতে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে যার প্রভাবে একটা গোটা যুগের অবসান হয়ে অন্য একটা নতুন যুগের আবির্ভাব ঘটে, তাকে শিল্পবিপ্লব নামে আখ্যায়িত করা হয়।
▶️শিল্পবিপ্লবের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
🚫লোহা ও ইস্পাতের অবাধ ব্যবহার
🚫জ্বালানি ও সঞ্চালক শক্তির ব্যবহার
🚫উৎপাদন,যাতায়াত ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে মনুষ্য ও পশুশক্তির পরিবর্তে কয়লা,তেল,বিদ্যুৎ, পরমাণু প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তি প্রয়োগ
🚫দ্রুত নগরায়ন, শ্রমিক শ্রেণির উত্থান, নতুন শাসনতন্ত্রের আবির্ভাব যার ফলে বংশভিত্তিক শাসন উঠে গিয়ে সমাজভিত্তিক শাসন আত্মপ্রকাশ করে।এবং জনগণ প্রজা থেকে হল নাগরিক।
🚫শ্রমিকরা দক্ষ ও অদক্ষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়
🚫মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক মানবিকতার পরিবর্তে পুঁজি বিনিয়োগ ও শ্রম প্রয়োগের নিরিখে বিচার করা আর্থিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিরূপিত হতে লাগল।
শিল্পবিপ্লবের কারণসমূহঃ
▶️কৃষিবিপ্লবঃ কৃষিবিপ্লবই শিল্পবিপ্লবের মূল ভিত্তি। সামন্ত যুগের অবসানের পর টিউডর যুগের সূচনা হলে ভূস্বামীরা জমির মালিকানা হারায় এবং কৃষকরা জমির মালিকানা লাভ করে। তাছাড়া যারা একটু বড় মাপের কৃষক ছিল তারা গরিব কৃষকের জমি কিনে নিয়ে কৃষি খামার তৈরি করে। শুরু হয় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং তারা বাড়তি মুনাফা ব্যাংকে লগ্নি করে ব্যাংক শিল্পে বিনিয়োগ করে।
▶️প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশঃ ইংল্যান্ডের অবস্থান ছিল আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর দিকে যার ফলে তার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ছিল এবং জলবায়ু ছিল নাতিশীতোষ্ণ। কয়লা ও লোহা শক্তির প্রাচুর্য ছিল এবং দেশের স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়া বয়ন শিল্পের উন্নয়নে সাহায্য করেছিল।
▶️প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং কয়লা ইন্ঞ্জিনের ব্যবহারঃ প্রযুক্তির উন্নয়ন শিল্পবিপ্লবের অপর একটি বড় কারণ। বাষ্প চালিত যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে বড় বড় ফ্যাক্টরি গড়ে উঠে এবং শিল্পোৎপাদনের হার বৃদ্ধি পায়। কয়লা ও ইস্পাতের ব্যবহার বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো শিল্পবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।
স্পিনিং জেনি ( জেমস্ হারগ্রেভস), ওয়াটার ফ্রেম, মিউল (স্যামুয়েল ক্রম্পটন), পাওয়ার লুম ( এডমুন্ড কার্টরাইট), স্টিম ইন্ঞ্জিন ( জেমস্ ওয়াট) এবং ফ্লায়িং শাটল ( মাকু) ইত্যাদি।
▶️মূলধনঃ এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায় উপনিবেশ গঠনের ফলে সেখান থেকে কাঁচামাল ও মূলধনের যোগান আসত।এছাড়াও তখন বিভিন্ন উৎস থেকে ইংল্যান্ডে মূলধনের যোগান আসছিল। ১৫,১৬ ও ১৭ শতকে ইংল্যান্ডে বাণিজ্য বিপ্লব সংঘটিত হয়। ১৬০০-১৭০০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে রপ্তানি ২ গুণের বেশি এবং ১৭০০ – ১৭৫০ সালে ৩ গুণের বেশি বৃদ্ধি পায়।
▶️ক্রমবর্ধমান পণ্য চাহিদাঃ এটি মূলত তিনটি কারণে সম্ভব হয়েছিল যথা- জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জনগণের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার। জনগণ শিল্পক্ষেত্রে কাজ করার ফলে তাদের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ফলে শিল্পের প্রসার ঘটে এবং পণ্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও ইংল্যান্ডে বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, পিউরিটান বিপ্লব, যুক্তিবাদ ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধের উদ্ভব, মুক্ত পরিবেশ, বিজ্ঞান ও দর্শনের চর্চা,সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অগ্রগতি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ নীতি শিল্পবিপ্লবের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।
শিল্পবিপ্লবের প্রভাবঃ
▶️শিল্পায়ন ও নগরায়ণের দ্রুত প্রসারঃ শিল্পায়নের ফলে বহুমুখী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এতে করে শ্রমের চলনশীলতা এবং মাথাপিছু শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।আবার শিল্পের স্থানীয়করণের ফলে নগরায়ন ত্বরান্বিত হয়।
▶️যান্ত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে সনাতন যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তে যান্ত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা শুরু হয়।ভৌগোলিক দূরত্ব হ্রাস পায়,জনজীবন সহজ,গতিশীল ও আরামপ্রদ হয়।এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত এবং শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
▶️কুটির শিল্পের ধ্বংস ও বেকারত্বের সৃষ্টিঃ কুটির শিল্পের ধ্বংস হয়ে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির সূচনা হলে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে অনেক শ্রমিক যান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে ব্যর্থ হয়ে বেকারে পরিণত হয়।সনাতন পদ্ধতিতে একজন শ্রমিক দিনে তিন জোড়া জুতো বানাতে পারতো, আর নতুন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেই একই কারিগর ৩০০ জোড়া জুতো বানাতে পারতো।
▶️যৌথ পরিবারের ভাঙ্গনঃ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের সাথে পরিবারের, পরিবারের সাথে সমাজের, শহরের সাথে গ্রামের নানা রকম মানবীয় পরিবর্তন সূচিত হয়।শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যায় যার ফলে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার সূচিত হয়।
▶️বুর্জোয়া ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধিঃ শিল্পবিপ্লবের ফলে বুর্জোয়া শ্রেণী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। অভিজাতশ্রেণী যে ক্ষমতা ভোগ করে আসছিল তা লোপ পায়নি তবে আগের তুলনায় অবস্থান দুর্বল হয়ে যায়।
▶️সমাজতান্ত্রিক মতবাদঃ
সমাজে সম্পদ বন্টণের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং শ্রমিকদের দারিদ্র্যের কথা ভেবে এধরনের মতবাদের সৃষ্টি হয়। তারা বলেন, শ্রমই হলো সম্পদের উৎস, আর কাঁচামাল প্রাকৃতিক সম্পদ।এতে সকলের সমান অধিকার আছে।রাষ্ট্রের উচিত শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মাধ্যমে শ্রমিকের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
▶️রাজনৈতিক প্রভাবঃ
🚫শিল্পপতি ও বণিকশ্রেনী শক্তিশালী হওয়ার ফলে ভূস্বামী ও হুইগ রাজনীতিকদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায়।
🚫নিজেদের অবস্থার উন্নতি করার জন্য শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শুরু করে।এর ফলে নিম্নতম মজুরি, কর্মক্ষেত্রে শ্রম ঘন্টা, বাসস্থান, বীমা প্রভৃতি আইন পাশ হয়।শ্রমিক শ্রেণি ভোটাধিকার লাভ করে।
🚫শিল্পবিপ্লবের ফলে পার্লামেন্ট সংস্কারের প্রয়োজন হয় কেননা এর ফলে অনেক নতুন শহর গড়ে উঠে, অনেক পুরাতন শহর ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং জনসংখ্যার ঘনত্বে রদবদল হয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাই, শিল্পবিপ্লব ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রভাবই নিয়ে আসছিলো।
বর্তমান বিশ্বের অগ্রযাত্রার পেছনে শিল্পবিপ্লব ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।


No comments