Header Ads

Header ADS

ইসরাইলের মাথাব্যথা- BDS মুভমেন্ট: উৎপত্তি ও বিকাশ

 


গতশতকের মতো একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও বিশ্বব্যাপী এক টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে উগ্র-সন্ত্রাসবাদের বিকাশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের টুইনটাওয়ারে হামলা, /১১ পরবর্তীসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধব্যানারকে সামনে রেখে ইংগ-মার্কিন জোটের মধ্যপ্রাচ্যে অনুপ্রবেশ এবং ইরাক-আফগানিস্তান দখল, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহা মন্দা ২০০৭-৮ , মুদ্রামান হ্রাস, আরব বসন্তের নামে মধ্যপ্রাচ্য উত্তর আফ্রিকার ক্ষমতার পরিবর্তন, পরবর্তীতে লিবিয়া, ইয়ামেন সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ এবং শেষমেশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের একনায়কতন্ত্র মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির রূঢ় পরিবর্তন আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে সর্বদা চাংগা রেখেছেপাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন, জুলুম- অত্যাচার- অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পুজিবাদী সমাজের পদ্ধতিগত শোষণের বিপক্ষে অবস্থান এবং বৃহৎ শক্তিদের অর্থনৈতিক সামরিক শক্তির জোরে এরূপ অহিংস অবস্থানকে নস্যাৎ করার প্রয়াস ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বই আজ অবগত

আজকে আমরা BDS Movement নামে বিকশিত হওয়া একটি অহিংস আন্দোলনের কথা সম্পর্কে জানবো যার মূললক্ষ্য ইস্রাইলের অবৈধ দখলদারিত্ব মানবাধিকার লংঘনকে পশ্চিমা বিশ্বের সভ্য সমাজের সামনে তুলে ধরা, এবং প্রচারণার মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে ইস্রাইলকে বয়কট ঘোষণা করা অতএব আজকের আলোচনায় আমরা প্রধানত দেখার চেষ্টা করবো  BDS মুভমেন্ট আসলে কি? এই মুভমেন্টের উৎপত্তি বিকাশ কিভাবে হয়েছে, এই মুভমেন্টের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল ইউরোপ উত্তর আমেরিকায়

 BDS মুভমেন্টের উৎপত্তি বিকাশঃ

সময়টা ২০০৫ সাল, ইসরায়েলের মানবাধিকার লংঘন অবৈধ দখলদারিত্ব বন্ধে পশ্চিম ইউরোপের অবস্থানরত একদল ফিলিস্তিনি এক্টিভিস্ট বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালানো শুরু করে যার মূললক্ষ্য থাকে বিশ্ব হতে ইসরায়েলকে বয়কট (Boycott), পরিত্যাগ (Divestment), এবং অর্থনৈতিক অবরোধ (Sanctions) করা, যার সামষ্টিক রূপ হল BDS মুভমেন্ট শুরুর পরপরই এই মুভমেন্ট বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে রূপ নেয়- বিশেষত পশ্চিমা দুনিয়ায়

আন্দোলনের শুরুতেই বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন, রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই মুভমেন্টকে সমর্থন প্রদান করেন ফলে দ্রুতই জাতিসংঘ স্বীকৃত ফিলিস্তিনিদের নিয়ে কাজ করা কয়েকশো সংস্থা এই আন্দোলনকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে প্যারিসে একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেন


আপনি BDS মুভমেন্টের ওয়েবসাইটে গেলে এই প্রচারণার শুরুর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন সেখানে স্পষ্ট ভাষায় উক্ত হয়েছে যে, প্রায় ৭০ বছর যাবৎ ইসরায়েল- ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতিগুলোকে অমান্য করে আসছে। ইসরায়েলি শাসকেরা ফিলিস্তিনি জনগণের উপর একটি বর্ণবাদী, দখলদারিত্ব ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেএযাবৎ এই কার্যক্রম সম্ভব হয়েছে বৃহৎ আন্তর্জাতিক শক্তির মদদে বানিজ্য (Corporations) এবং প্রাতিষ্ঠানিক (Institutions) দুনিয়ায় ইসরায়েলের অসম আধিপত্যের দরুণ এই জুলুম বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার সমতার ক্ষেত্রে যে প্রচেষ্টা অব্যাহত সে বিষয়টি বরাবরই চাপা পড়ে গেছে

আত্ম-নিয়োন্ত্রণ (Self-determination) ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধচারণ করতে যে রাজনৈতিক সংগ্রামের দরকার BDS মুভমেন্ট সেক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মুভমেন্ট যেমনঃ South African Anti-apartheid Movement, American Indian Movement, the Civil Rights and Black Power movements in the U.S. প্রভৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। BDS মুভমেন্টে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে ফিলিস্তিনিদেরকে আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার ফিরিয়ে দিচ্ছে- ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্ব মানবাধিকার লংঘনের বিপক্ষে এই অহিংস মুভমেন্ট পরিচালিত হবে

তিনটি নির্দিষ্ট দাবীকে সামনে রেখে BDS মুভমেন্ট পরিচালিত হয়েছে যথাঃ

1.    ইস্রাইলকে আরব-ভূখন্ডে অবৈধ দখলদারিত্ব ঔপনিবেশিক শাসন বন্ধ করতে হবে এবং অবশ্যই সীমানা প্রাচীর ভেংগে ফেলতে হবে

2.    ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার দিতে হবে এবং ইস্রাইলে অবস্থানরত আরব ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে সম-অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

3.    সর্বোপরি, জাতিসংঘের ১৯৪ নম্বর রেজুলেশনকে মেনে নিয়ে ফিলিস্তিন শরনার্থীদের ঘরে ফিরতে দিতে হবে এবং তাদের কব্জা করা সম্পদও ফিরিয়ে দিতে হবে

তাদের দাবীগুলো খুবই পরিষ্কারদুই-রাষ্ট্র নীতি, এক-রাষ্ট্র নীতি ইত্যাদি প্রস্তাবনাকে তারা তখনই মানতে রাজি হবে যখন উপরোক্ত দাবীগুলো মেনে নেয়া হবে এবং কাজে দেখাতে হবে

BDS মুভমেন্টের প্রতিক্রিয়াঃ

সুচনার পরপরই BDS মুভমেন্ট প্রচারণা প্রথমে ইউরোপে উত্তর আমেরিকা আলোড়িত করে- পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বব্যাপী তা ছড়িয়ে পরে বৈশ্বিক প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে পরিচালনা পর্ষদ বিভিন্ন বহুজাতিক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে যারা দীর্ঘদিন যাবৎ ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্ব তৈরিতে সহায়তা করেছে।  ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক ভেলু কমে যেতে শুরু করে, ব্যবসায় বিনিয়োগ কমে যায় এবং সর্বোপরি তাদের আন্তর্জাতিক চাপের সম্মুখীন হতে হয় এই পদ্ধতিতে অনেক কাজে দেয় অভ্যন্তরীণ চাপের ফলে ২০১৫ সালে ফ্রান্সের বহুজাতিক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান Veolia ইসরায়েলকে দেয়া তাদের বার্ষিক অনুবাদ ভর্তুকি বন্ধ করে এবং ইসরায়েলি মার্কেট থেকে তারা সরে আসেপরবর্তী ২০১৬ তে, আইরিশ বৃহৎ কনস্ট্রাকশান কোম্পানি CRH, বৃটিশ নিরাপত্তা কোম্পানি G4S প্রভৃতি ইসরায়েলি মার্কেট থেকে বের হয়ে যায়

একে তো দীর্ঘদিন অসংখ্য ট্রেড ইউনিয়ন এই অহিংস আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছিলো, যখন বয়কটের পর, ইসরায়েলকে পরিত্যগের (Divestment) ঘোষণা বা প্রচারণা শুরু হল- বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারী, নেদারল্যান্ডস স্ক্যান্ডেনেভিয়ানদের পেনশনের টাকা এবং উত্তর আমেরিকার প্রটেস্ট্যান্ট চার্চগুলো থেকে বড় আকারে ডোনেশন আসা শুরু করল

মার্চ ২০১৬ তে BDS মুভমেন্টের পরিচালনা পর্ষদ জাতিসংঘকে চাপ দেয় সকল আন্তর্জাতিক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উপাত্ত সংগ্রহে যারা এই দীর্ঘদিন ইসরায়েলের অবৈধ স্থাপনার ক্ষেত্রে প্রসারে সহায়তা করেছেজানুয়ারি ২০১৮ তে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন একটি রিপোর্ট জমা দেন যেখানে তথ্য-উপাত্তসহ ২০৬ টি আন্তর্জাতিক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়, যারা অবৈধভাবে স্থাপনা বিন্যাসের সাথে যুক্ত- যার সিংহভাগই যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলের

BDS মুভমেন্টের ক্ষেত্র প্রসারে সহায়তা করেন পশ্চিমা ইউরোপ, বিশেষত যুক্তরাজ্য উত্তর আমেরিকার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা২০১২ সালে Students Justice for Palestine (SJP) নামে একটি অহিংস আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয়, যা বর্তমানেও আছে ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের জাতীয় শিক্ষার্থী ইউনিয়ন (NUS)- দেশব্যাপী প্রচারণা চালিয়ে প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী ইউনিয়নকে BDS মুভমেন্টকে সমর্থন প্রদানে সহায়তা করেছেআসলেই এটা ছিল বিশাল অর্জন এই মুভমেন্টেরপরবর্তী বছরে যুক্তরাজ্য়ের সর্ববৃহৎ শিক্ষার্থী ইউনিয়ন যেটা ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে পরিচালিত হত তারাও এই আন্দোলনকে গ্রহণ করে নেয়

একাডেমিকদের মধ্যেও BDS মুভমেন্টকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়, এবং the Association for Asian American Studies, the American Studies Association, the Native American and Indigenous Studies Association, and National Women’s Studies Association প্রভৃতি ডিপার্টমেন্টগুলো- ইসরায়েলি একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বয়কট করে, এবং শতশত একাডেমিকরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন তারা ইসরায়েলের মদদপুষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করবেন না এবং এগুলোকেও বয়কট করবেন পাশাপাশি ইসরায়েলের সমর্থক বিভিন্ন প্রফেসরদের ইসরায়েলকে বয়কট করার জন্য চাপ দিতে থাকেন

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথেসাথেই সাংস্কৃতিক অংগন থেকেও ইসরায়েলকে বয়কটের জোর প্রচারণা চালানো হয়, এবং অসংখ্য আর্টিস্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ যেমনঃ Alice Walker, Henning Mankell, Roger Waters, Naomi Klein, Ken Loach, Judith Butler, Elvis Costello প্রভৃতি এই প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই প্রায় একহাজার যুক্তরাজ্যের আর্টিস্ট বয়কটের পক্ষে স্বাক্ষর প্রদান করেন এবং বিশ্বব্যাপী অন্য আর্টিস্টদেরকেও বয়কট সমর্থনে আহবান জানানসাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সাথে অনেক জনপ্রিয় ফুটবলারের অংশগ্রহণ যেমন মাইকেল বেনেট এই মুভমেন্টকে আরো তীব্র করে

এই ছিল আমাদের প্রথম পর্বের আলোচনা আশাকরি আপনারা BDS মুভমেন্টের উৎপত্তি, বিকাশ এবং মুভমেন্টের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছেন পরবর্তী অংশে আমরা দেখানোর চেষ্টা করবো এই তীব্র মুভমেন্ট যাদের স্বার্থে আঘাত করতেছিল অর্থাৎ ইসরায়েল তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, তারা কি ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন এই মুভমেন্টকে দমিয়ে দেয়ার জন্য, এবং আসলেই কি মুভমেন্টটি শেষ হয়ে গিয়েছে, না এখনো চলমান আছে? ধন্যবাদ

 

 বদিরুজ্জামান 
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.