Header Ads

Header ADS

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও যুক্তরাষ্ট্র: বাস্তবতা নাকি কল্পনা

 

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দেশের একদিনে স্বাক্ষরিত কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির নাম প্যারিস জলবায়ু চুক্তি। ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর হতে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের লা বুর্জেতে অনুষ্ঠিত হয় জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলন Conferennce of the Parties বা COP এর ২১ তম সম্মেলন। বস্তুত এই জলবায়ু সম্মেলন আসলে কি? ১৯৯৪ সালের মার্চে কার্যকর হয় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কনভেনশন UN Framework Convention on Climate Change বা সংক্ষেপে UNFCCC. এটি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই UNFCCC প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন Conference of the Parties বা COP পালন করে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় COP এর ২১ তম সম্মলন হলো প্যারিস সম্মেলন।

এই কনভেনশনে সকল সদস্য দেশ অর্থাৎ ১৯৭ টি দেশের ঐক্যমতের ভিত্তিতে UNFCCC এর আওতায় একটি জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তি গৃহীত হয়, যা ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি বা Paris Agreement নামে পরিচিত। চুক্তিটি ২২শে এপ্রিল ২০১৬ থেকে ২১শে এপ্রিল ২০১৭ পর্যন্ত প্রায় এক বছর জাতিসংঘের সদর দপ্তরে স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত ছিলো। তবে ২২শে এপ্রিল ২০১৬, বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে একদিনেই ঐতিহাসিক প্যরিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ১৭৫ টি দেশ। যা একদিনে স্বাক্ষরিত কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে রেকর্ড। এর আগে একদিনে সর্বাধিক দেশের চুক্তি স্বাক্ষরের রেকর্ড ছিলো ১৯৮২ সালে স্বাক্ষরিত মন্টিগো সমুদ্র আইন কনভেনশনের। "মন্টিগো বে কনভেনশন অন দ্যা ল' অব দ্যা সী" শীর্ষক ওই চুক্তিতে একদিনে ১১৯ টি দেশ স্বাক্ষর করেছিলো। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সে রেকর্ড অতিক্রম করলো যদিও শর্ত অনুযায়ী চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার জন্য ৫৫ শতাংশ গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমনকারী ৫৫ টি দেশের অনুসমর্থনের প্রয়োজন ছিলো। গত ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবরে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে যায়। শর্ত হিসেবে ৫৫ টি দেশের অনুসমর্থনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ৩০ দিন পর থেকে চুক্তিটি কার্যকর হবে। সেই হিসেবে মরোক্কোর পর্যটন শহর মারাকেশে অনুষ্ঠেয় COP-22 এর আগেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তিটি কার্যকর হয়। 



প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মূল উপজীব্য হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কার্বন নির্গমন কমানো ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে চুক্তির খসড়া প্রণয়ন এবং চুক্তিটি কতটা অগ্রগতি হচ্ছে পাঁচ বছর পর পর তা খতিয়ে দেখা। এখানে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্রস্তাব করা হয়। যার অর্থ হলো বিশ্বে মোট গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমান হবে ৩.৬ ট্রিলিয়ন টন। এছাড়াও তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। এ লক্ষ্যে জীবাষ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও এ সম্মেলনে আরেকটি বড় আলোচনার বিষয় ছিলো কার্বন নিঃসরণে বিপুল পরিমানে অর্থের যোগান ও প্রযুক্তি সহায়তা নিয়ে আলোচনা। ২০২০ সালের মধ্যে ধনী দেশগুলো ১০০ বিলিয়ন ডলার এর যোগান দেবে যা উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুকি মোকাবেলায় দেওয়া হবে। ২০২৫ সালে এ অর্থের পরিমান পরিবর্তিত হবে। তবে ২০২০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলো যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাচ্ছে তাতে সন্তুষ্ট নন অনেক দেশ। তারা মনে করেন যে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২০ সালের পরও ১০০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা অব্যহত রাখা প্রয়োজন। 

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়ন কতটা বাস্তবসম্মত? এর ভবিষ্যৎ কি শুধুই ধোয়াশা নাকি একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী? যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আশংকা করা হচ্ছিলো যে, ট্রাম্প জলবায়ু চুক্তি থেকে বের হয়ে আসতে পারে, কারন এটি ছিলো তার নির্বাচনী প্রচারণার একটি অংশ। কার্যত ট্রাম্প ২০১৭ সালের জুনে এ চুক্তি থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। ট্রাম্পের মতে এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্যায্য। তাছাড়া এ চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও কর্মীদের ক্ষতি হবে। চাকরী হারাবে প্রায় ৬৫ লাখ কর্মী এবং জিডিপির প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ট্রাম্প আরও বলেন যে, যে চুক্তিই আমেরিকার নাগরিকদের স্বার্থ হানি করবে ট্রাম্প সরকার তা থেকে বের হয়ে আসবে বা চুক্তিতে নতুন করে দরকষাকষি করবে। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় বৈশ্বিক ১৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনে লড়ে যাওয়া দেশগুলোকে বড় ধরনের সহায়তার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জাতিসংঘের করা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে বড় ধরনের অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। ট্রাম্প গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডে অর্থায়ন বন্ধেরও ঘোষণা দিয়েছে। এটা নিশ্চিতই বলা যায় ট্রাম্পের এ ঘোষণায় এসব কর্মকান্ড বাধাপ্রাপ্ত হবে। 



এমনকি রাশিয়াও ট্রাম্পের ঘোষনার পর বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র এ চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার ফলে চুক্তি বাস্তবায়ন যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়বে। জাতিসংঘের প্রেসিডেন্ট অ্যান্তেনিও গুতেরেস এ প্রসঙ্গে বলেছেন যে,প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়ন করা অত্যান্ত জরুরী। যুক্তরাষ্ট্রের এ চুক্তি থেকে সরে যাওয়ায় তিনি বলেন যে, বৈশ্বিক নেতৃত্বের স্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সরিয়ে নিলে সেই শূণ্যস্থান রাশিয়া, চীনের পাশাপাশি সোদি আরব, তুরষ্ক, ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো পূরণ করবে। তিনি আরও বলেন যে, অতি উচ্চাশা সহকারে ২০১৫ সালে সম্পাদিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বিশ্বকে অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। ট্রাম্পের ঘোষনার পর বিশ্ব নেতারা বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ট্রাম্পের নির্বাচনী শ্লোগান, "Make America Great Again" এর সূত্র ধরেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন,  Make or plannate great again. এছাড়াও যৌথ বিবৃতিতে জার্মানী, ফ্রান্স ও ইতালীর শীর্ষ নেতারা বলেন যে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে যে মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিলো তা অপরিবর্তনযোগ্য এবং আমাদের গ্রহ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত প্যারিস চুক্তি নিয়ে কোনো দরকষাকষি সুযোগ নেই। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জ্যঁ ক্লদ জাঙ্কার বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের এটি মারাত্নক ভুল সিদ্ধান্ত, তবে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নারী মুখপাত্র হুয়াং চুংইয়ং বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাড়ানোর পর এ চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব চীনের কাঁধে এসে পড়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাষ্যমতে অর্থনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষতি না করেই বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ সম্ভব। ২০১৪ সালের অক্টোবরে ইইউ বাতাসে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ রোধে একটি বিশেষ চুক্তি করে যার লক্ষ্য ইইউ ভুক্ত ২৮ দেশের গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ ২০৩০ এর তুলনায় ৪০ শতাংশ কমিয়ে দেবে।  ইইউ এর আগেও ২০২০ সাল নাগাদ ২০ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস কমানোর লক্ষ্যে চুক্তি করেছিলো। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্রীনহাউজ নিঃসরণকারী দেশ চীন। তারাও এ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে আশাবাদী। তারা বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ চীনের গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ সর্বোচ্চ হবে এবং পরের সালগুলো থেকে কমতে থাকবে। এখন এটিই দেখার বিষয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বর্তমান বিশ্বের উঠতি শক্তির হাত ধরে চলা উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলো প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে কতটা কার্যকর করতে পারে। কেননা আমরা যদি পূর্ববর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো জলবায়ু নিয়ে ১৯৯৭ সালে জাপানে অনুষ্ঠেয় কিয়েটো প্রোটোকল থেকে যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে আসে। এবং কিয়েটো প্রটোকলে নির্দিষ্ট কিছু শিল্পোন্নত দেশের বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিঃসরণের যে পরিমাণ বেঁধে দেওয়া হয় তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়।





খালেদ মাহমুদ আকাশ 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.