শিকাগো বয়েজ ও লাতিন আমেরিকার মুক্তবাজার অর্থনীতি- প্রেক্ষাপট চিলি
![]() |
| শিকাগো বয়েজ |
“শিকাগো বয়েজ” নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করার সময় প্রফেসর আরনল্ড হারবার্গার- লাতিন আমেরিকার সরু দেশ চিলিকে উল্লেখ করে বলেছিলেন, “ ১৯৯৫ সালে চিলি একটি রত্ন (Jewel) হতে না পারলেও, আজ চিলি নিজেকে লাতিন আমেরিকার রত্নে পরিণত করেছে।“ প্রফেসর হারবার্গার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অর্থনীতিবিদ। তিনি ছিলেন স্যার মিলটন ফ্রিডম্যানের সমসাময়িক এবং সহকর্মী। উল্লেখ্য, স্যার মিল্টন ফ্রীডম্যান ছিলেন শিকাগো বয়েজের কেন্দ্রীয় আইকন- অর্থাৎ ফ্রিডম্যানের মতাদর্শে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল চিলির কিছু নাম করা অর্থনীতিবিদ- যারা শিকাগো বয়েজ নামে সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকায় পরিচিতি লাভ করে। ফ্রিডম্যানের মতাদর্শ ছিলো মুক্ত-বাজার অর্থনৈতিক দর্শন- এবং শিকাগো বয়েজ খুব উৎসাহ-উদ্দীপনা ও চিলির ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা পিনোচিতের সমর্থন নিয়ে চিলিকে এই আদর্শের চারনভূমি হিসেবে রূপান্তর ঘটাতে চেয়েছেন। শিকাগো বয়েজের ধার করে আনা এই আদর্শ পরবর্তীতে চিলির সমগ্র আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। দীর্ঘমেয়াদে, চিলিকে গড়ে তোলে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ হিসেবে, যদিও এই সম্পদের বেশিরভাগই ছিলো ১ শতাংশ লোকের হাতে।
২০১১ সালে চিলির ছাত্র সমাজ দেশের অর্থনৈতিক অসমতা, নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বিশাল আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনের ফলে সরকারের বোধোদয় হওয়া শুরু করে যে শিকাগো বয়েজের প্রবর্তিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে যা সামগ্রিক সামাজিক পরিবর্তনে নেতিবাচক রূপকে প্রকাশ ঘটাচ্ছে। মিডিয়াগুলো আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে ঢালাওভভাবে প্রশ্ন করতে থাকলো। যেমনঃ
আসলে কি হতে যাচ্ছে চিলিতে?
শিক্ষার্থীরা কিসের পরিবর্তন ঘটাতে চাচ্ছে?
চিলির সাধারণ নাগরিকরা কেন আজ বৈষম্যের শিকার?
এতদিন সফলভাবে চলে আসা শিকাগো বয়েজের মুক্তবাজার অর্থনীতি কেনই বা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে? ইত্যাদি।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী একটি ডকুমেন্টারি দেখানো শুরু করেন যেখানে দেখানো হয় কিভাবে ফ্রিডম্যান- চিলির এই নামী অর্থনীতিবিদদের মগজ ধোলাই করেছেন তার মতাদর্শ (মুক্ত-বাজার অর্থনীতি) দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। এখানে আরো দেখানো হয়েছে, কিভাবে চিলির সামরিক জান্তা অগাস্টা পিনোচেট চিলিতে নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়া রাখতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যেচার ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের নব্য উদারবাদী অর্থনীতির সাথে চিলিকে জড়িয়ে ফেলছেন, এবং শিকাগো বয়েজ কিভাবে পিনোচেটের স্বার্থে কাজ করা শুরু করল।
শিকাগো বয়েজের নির্দেশনা অনুসারে পিনোচেট দেশে বেসরকারিকরণ প্রকল্প হাতে নেন যার মূল লক্ষ্যই ছিলো সরকারি সেক্টরগুলোকে ক্রমান্বয়ে বেসরকারিকরণ- এমনকি দেশের নাগরিকদের দেয়া বিভিন্ন প্রণোদনা যেমনঃ বয়স্ক ভাতা- তাকেও বেসরকারি পদ্ধতির আওতায় আনা হয়। মজার বিষয় হলো, যে যুক্তরাষ্ট্র এই মুক্তবাজার ও নব্য উদারবাদী অর্থনীতির রূপকার, সেখানে যদিও বেসরকারিকরণ আর্থ-সামাজিক একটা অসমতা সৃষ্টি করেছে- তবুও বেসরকারিকরণে চিলির মত এত এক্সট্রিম পর্যায়ে স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রও যায়নি।
যাইহোক, এই ডকুমেন্টারিতে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ পায়। এখানে পরিস্কারভাবে তুলে ধরা হয় কিভাবে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ও চিলির সান্তিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষার্থী বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী চিলির কিছু সদ্য গ্রাজুয়েট অথবা আন্ডারগ্রাজুয়েট অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে Monetarism বা মুদ্রা ব্যবস্থায় গভীর জ্ঞানার্জনে। উল্লেখ্য, এই মুদ্রা ব্যবস্থা তত্ত্বের মূল লক্ষ্যই হবে বাজার ব্যবস্থার উপর থেকে সরকারের সকল ধরণের হস্তক্ষেপ তুলে নেয়া; বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যেতে সহায়তা করা শুধু মুদ্রা সংস্থানের (Money Supply) কর্তৃত্বটাই রাষ্ট্রের হাতে থাকবে। এমনকি এই চুক্তির মুল কথাগুলো- মুক্তবাজার ব্যবস্থার প্রচলন- স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছেই ছিলো একটি নতুন আইডিয়া ও অভিজ্ঞতা। যুক্তরাষ্ট্রের এই শিক্ষার্থী বিনিময় প্রথার প্রচলন ও তাদের নানাবিধ সুযোগ সুবিধা প্রদানকে যুক্তরাষ্ট্র মূলত একটি বড় বিনিয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো,যার প্রাথমিক লক্ষ্যই ছিলো লাতিন আমেরিকার উপর তার একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখা -পাশাপাশি, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচারিত মতাদর্শ- সমাজতন্ত্রকে রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। চিলিকে যুক্তরাষ্ট্র এই পরিকল্পনার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করে।
১৯৫৬-১৯৬১ সালে, প্রায় ২৫ জন চিলিয়ান শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের প্রত্যেককে একটি করে ভিডিও ক্যামেরা কিনে দেন যেটা তখনকার লাতিন আমেরিকায় ছিলো প্রায় দুঃষ্প্রাপ্য। ক্যামেরার সাহায্যে তারা তাদের আনন্দ-অনুষ্ঠান, শিক্ষা সফর, শিক্ষা পদ্ধতি, উচ্চ লাইফ স্টাইল ইত্যাদি শুট করেন। একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের প্রত্যাহিক কর্মজীবন ও ধীরে ধীরে পন্ডিত হিসেবে গড়ে ওঠা সেই ক্যামেরায় ধরা পরতে থাকে। পরে তারা সেগুলোকে একত্রিত করে কিছু ডকুমেন্টারি তৈরি করেন, এবং দেশব্যাপী সেগুলো ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। শিকাগো বয়েজ এই আশায় চিলিতে প্রত্যাবর্তন করেন যে তারা চিলিতে আমেরিকায় তাদের শিখে আসা মুক্ত-বাজার অর্থনৈতিক জ্ঞানকে বাস্তবায়িত করবেন। তাই তারা সমগ্র চিলির অর্থনৈতিক রিফর্মের ডাক দেন, এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ আলে সান্দ্রেকে সেই ডাকে সাড়া দেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু ইতোমধ্যে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ডানপন্থী আলে সান্দ্রে, সমাজতন্ত্রী সালভাদর আলেন্দের নিকট পরাজিত হন।
বামপন্থী আলেন্দের কাছে তেমন একটা পাত্তা না পেলেও, বয়েজ তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে আরো ব্যপক গবেষণা চালাতে থাকেন, এবং এই প্রজেক্টের নাম দেন “দি ব্রিক”। অবশেষে, শিকাগো বয়েজের মূল আহ্বায়ক ডি ক্যাস্ত্রোন তাদের প্রজেক্টের সাথে নৌ এডমিরাল জোসে মেরিনোকে পরিচয় করান, এবং প্রজেক্টকি মেরিনোর খুব মনে ধরে। এদিকে জোসে মোরিনো ১৯৭৩ সালে CIA এর মদদে সালভাদর আলেন্দেকে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা থেকে অপসারন করেন এবং অগাস্টা পিনোচেটকে দেশের সুপ্রিম লিডার হিসেবে ঘোষণা করেন। চিলির সামরিক জান্তা পিনোচেট জোসে মোরিনের কল্যানে শিকাগো বয়েজের প্রধান চরিত্র ডি ক্যাস্ত্রোকে প্রথমে অর্থমন্ত্রী- পরবর্তীতে রাজস্ব মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ডি ক্যাস্ত্রোর বদৌলতে শিকাগো বয়েজের অন্যান্য সবাই পিনোচেটের সামরিক শাসনের সাথে মিশে যান, এবং দীর্ঘ ১৭ বছর দেশের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন সাধন করেন।
শিকাগো বয়েজের প্রাথমিক প্রোগ্রামটি ছিলো কিভাবে দেশব্যাপী যে উচ্চ-মুদ্রাস্ফীতি তৈরি হয়েছে তার হার হ্রাস করে অর্থনৈতিক ভারসাম্য অর্জন করা যায়। উপায় হিসেভে বয়েজ দেশের মূলধন নিয়ন্ত্রণের (Capital Control) উপর অধিক জোর দেন। পরবর্তীতে, তারা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য দেশের বাজারকে উন্মুক্ত করে দেন, রপ্তানির থেকে আমদানির উপর জোর দেন, রাষ্টায়ত্ত্ব শিল্প-কারখানাগুলোকে বেসরকারি মালিকানায় রূপান্তর ঘটান এবং বেসরকারি বা বেক্তি মালিকানাধীন অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে আলেন্দের সরকার যে নিয়ম-নীতি অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছিল সেগুলোর বিলুপ্তি ঘটান। শিকাগো বয়েজের এই রিফর্মগুলো বিরোধী বামপন্থী দলগুলো মেনে নিচ্ছিলো না, ফলে পিনোচেট বিরোধী মত দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যেমনঃ গুম, খুন ও জেলখানায় বন্ধী করে রাখা। আমেনেস্টি ইন্টারনেশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী, পিনোচেটের ক্ষমতার ২০ বছরে কয়েক হাজার মানুষকে পিনোচেট হত্যা করেছে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকতে, এবং গুম ও এরেস্ট করা হয়েছে এর দিগুণ।
কিন্তু যখন পিনচেটের এই নৃশংস মানবাধিকার লঙ্ঘন আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে দিলো,সবাই পিনোচেটকে মানবাধিকার অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করতে লাগলেন। ঠিক তখন পিনোচেট যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ফ্রিডম্যানের মুক্তবাজার অর্থনীতিকে চিলিতে বাস্তবায়িত করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো মিডিয়া চিলির পক্ষ নিয়ে চিলির অর্থনীতির ইতিবাচক দিক নিয়ে পিনোচেটের প্রশংসাসূচক লেখা ছাপাতে থাকেন, এমনকি ১৯৭৫ সালে ফ্রিডম্যান পিনোচেটের সাথে চিলিতে সাক্ষাৎ করেন এবং শিকাগো বয়েজকে তার মতাদর্শকে চিলির অর্থনীতির দীর্ঘ পরিকল্পনায় স্থান দিতে সুপারিশ করেন। কিন্তু, গণতন্ত্রের ধারক বাহক যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিডম্যানের মাধ্যমে চিলির সামরিক জান্তার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন খুব নেতিবাচক হিসেবে দেখেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দেন চিলির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে।
যাইহোক, ১৯৯০ সালে বিশাল জনবিক্ষোভের মধ্যদিয়ে পিনোচেট শাসনের ইতি ঘটে। সকলে চাচ্ছিলো দেশের সংবিধানের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে কারণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পিনোচেট নানা সময়ে বিবিধ পরিবর্তন এনেছিলেন এই সংবিধানে, বিশেষত অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূলনীতিতে। কিন্তু এতকিছুর পরেও শিকাগো বয়েজের প্রবর্তিত নব্য উদারবাদী মুক্তবাজার অর্থনৈতক ব্যবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন আসলে ঘটেনি। কারণ হিসেবে দুটি বিষয়ের কথা বলা যায়ঃ প্রথমত শিকাগো বয়েজ নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে পূর্বের অর্থ্নৈতিক পদ্ধতির একদম শিকর থেকেই পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন, এবং ১৯৯০ পরবর্তী আন্তর্জাতিক অর্থনীতিও কিন্তু সেই নব্য উদারবাদী নীতিকেই অনুসরণ করে চলেছে। তাই চিলি এখান থেকে মুক্তি আসলে পায়নি।
কিন্তু চিলির এই ব্যপক হারে বেসরকারিকরণ এবং রপ্তানির পরিবর্তে আমদানিকে জোর দেয়া, এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিকট বাজারকে উন্মুক্ত করা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় চরম বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। পরিসংখ্যাগুলোতে ভয়ংকর সব তথ্য উঠে এসেছে, যেমন যেখানে অধিকাংশ চিলিয়ানদের মাসিক আয় সর্বচো ৪৫০ মার্কিন ডলার, সেখানে মাত্র ০.১ শতাংশ চিলিয়ানদের মাসিক আয় প্রায় ৯০ হাজার মার্কিন ডলার। এ এক চরম বৈষম্য যা সৃষ্টি হয়েছে শুধু এই নব্য উদারবাদী অর্থনীতির এক্সট্রিম ব্যবহারের জন্য। শিকাগো বয়েজকে এখানে দায়ভার সম্পূর্ণ দেয়া যায় না এই শ্রেণীবাদ সৃষ্টি হওয়ার জন্য, এর পিছনে ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এবং চিলি সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে পরীক্ষিত হল।
মূল লেখকঃ তানিয়া অপাজো
চিলিয়ান সিনিয়র সাংবাদিক
হাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়য়।


No comments