আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সিস্টেম যে কারণে নৈরাজ্যপূর্ণ (Anarchic)
![]()  | 
| Anarchy in International Relations | 
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বিশৃঙ্খলা (Chaos), সংঘর্ষ (Violence), এবং অনাচার ও অরাজকতার/ আইনশূন্যতা (lawlessness) পরিস্থিতিকে বুঝাতে আমরা Anarchy শব্দটার ব্যবহার করি। ইংরেজি শব্দ Anarchy-এর পারিভাষিক অর্থ হতে পারে বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য, তবে কনসেপ্ট হিসেবে Anarchy শব্দটি আরও ব্যপক বহন করে।
প্রাচীন গ্রীক শব্দ Anarchos থেকে Anarchy  শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। গ্রীকরা Anarchos শব্দটি দ্বারা 'রাজা শূন্য রাজ্য' কে বুঝাতো। অর্থাৎ, রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার মত যখন কোন শাসক গোষ্ঠী না থাকে সেইরূপ অবস্থাকে প্রাচীন গ্রীসে Anarchos বলা হত। আধুনিক সময়ে, কোন রাষ্ট্রে সরকারের অনুপস্থিতিতে যে পরিস্থিত উদ্ভূত হয় তাকে বুঝাতে Anarchy শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
সমাজ বিজ্ঞানের দুনিয়ায় Anarchy বা নৈরাজ্য বিপ্লবী চেতনার সূচনা থেকেও ঘটতে পারে, কারণ বিপ্লবী চেতনা চলমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে, এবং সে চেতনা বাস্তবায়নে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে । বর্তমানে বেশ কিছু সাইন্স ফিকশন ও অন্যান্য ঘরনার লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা Anarchy ধারণাটিকে পুঁজি করে মানব জাতির এক নতুন ভবিষ্যৎ চিত্রায়িত করার প্রচেষ্টায় মশগুল রয়েছেন। 
যেমন ধরুন, মার্ভেল এভেঞ্জার সিরিজে থানোস যেভাবে নতুন আঙ্গিকে ইউনিভার্সকে সাঁজাতে চেয়েছে তা শুধু তখনই সম্ভব যখন ইউনিভার্সে একধরণের Anarchy বা নৈরাজ্য বিরাজ করবে। আবার ধরুন, ক্রিস্টোফার নোলানের BATMAN মুভি সিরিস যেখানে প্রতিটি এন্টাগোনিস্ট/ বিরোধী চরিত্রঃ রাজ’আ গুল, জোঁকার, ও মাস্কম্যান বেইন চলমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে। ফলে নোলানের সিনেমার যে পৃথিবী, অর্থাৎ, গোথাম শহরে এন্টাগোনিস্টরা Anarchy বা নৈরাজ্যকে উস্কে দিতে চায় যাতে তাদের নতুন বিপ্লবী ধারণায় গোথাম শহরকে নতুন করে তারা সাঁজাতে পারে। 
আন্তর্জাতিক রাজনীতি/ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পাঠ্যক্রমের শিক্ষার্থীদের কাছে Anarchy শব্দটি আরো বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলতে ধরে নেওয়া হয় এটি একটি Anarchic বা নৈরাজ্যে ভরা দুনিয়া/ সিস্টেম। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা/ সিস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু রাষ্ট্রের রাজনৈতিক/অভ্যন্তরীণ কাঠামো বা সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার নামে একটি গোষ্ঠী বা অথরিটি থাকলেও, আন্তর্জাতিক রাজনীতি/বাহ্যিক কাঠামো বা সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ বা রক্ষণাবেক্ষণে কোন কেন্দ্রিয় সরকার বা অথরিটির দেখা মেলে না। 
কিন্তু কেন?
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা/সিস্টেম নিয়ন্ত্রণে কোন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, কেননা অনেকগুলো রাষ্ট্র মিলে আন্তর্জাতিক সিস্টেম তৈরি হয়েছে । উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হল, আন্তর্জাতিক সিস্টেমের প্রতিটি রাষ্ট্রই স্বাধীন ও সার্বভৌম। ফলে, নিজের সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রটি তার প্রতি অন্যের ( সে হোক কেন্দ্রীয় সরকার বা অন্য কোন দেশ) হস্তক্ষেপ বা খবরদারীকে কখনই মেনে নিবে না। সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবে, সে নিজেই বিবেচনা করবে কখন তার সংঘাতে জড়ানো দরকার,  কখন তার শান্তি চুক্তি করা দরকার, বা কখন সে মৈত্রী গঠন করবে বা কখন সে মৈত্রী থেকে বের হয়ে যাবে।
Anarchy অতি প্রাচীন একটি কনসেপ্ট হলেও, এই ধারণাটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনুষঙ্গ করেন দার্শনিক থমাস হবস। তিনি তার বিখ্যান Leviathan গ্রন্থে প্রাকৃতিক পরিবেশকে Anarchic বা নৈরাজ্যপূর্ন বলেছেন। পরবর্তীতে হবসের এহেন নৈরাজ্যের ধারণাঃ “আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি (International ‘state of nature'),” লিবারেলিজম ও রিয়লিজমসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন তত্ত্ব বিকাশের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। 
থমাস হবস তার আইডিয়াকে এভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন যে মানুষ স্বভাবগত কারণেই যৌক্তিক (Rational), এবং যৌক্তিক প্রবণতাই মানুষকে কোন নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থান থেকে মানুষ নিজেদের একটি শক্ত - প্রতিষ্ঠিত ও নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থার অংশ করতে চায়, যাকে হবস তার গ্রন্থে লেভিয়াথান দৈত্যের সাথে তুলনা করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সে দৈত্যের নাম স্বার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র, যা সমাজের নাগরিকদের নৈরাজ্য থেকে নিরাপত্তা দেবে। 
এভাবেই, এই সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমন্বয়ে যে আন্তর্জাতিক সিস্টেম তৈরি হয়েছে এবং যে সিস্টেমটি বিশৃঙ্খল, সে বিশৃঙ্খলা থেকে সমাজ, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের রক্ষা করতে রাষ্ট্র আবারও তার সার্বভৌম ধারণাকে আকড়ে ধরবে। অর্থাৎ, প্রতিটি রাষ্ট্রই যৌক্তিক হওয়ায়, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় রাষ্ট্র তার সার্বভৌম নীতিকে অনুসরণ করবে, অর্থাৎ নিজের রাষ্ট্রকে নিরাপদে রাখবে। 
রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমের ধারনার সাথে আন্তর্জাতিক সিস্টমে সামঞ্জস্য রাখাকে থমাস হবস Domestic Analogy হিসেবে নামকরণ করেছেন। অর্থাৎ, যেভাবে সার্বভৌম ক্ষমতাকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ভিতরে নৈরাজ্য প্রতিরোধ করে নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করা হয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তেমনি নৈরাজ্যে ভরা আন্তর্জাতিক সিস্টেমে নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থ/ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্বকে অটুট রাখবে।  
হবসের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থা (State of Nature) খুবই কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। এটাকে হবস জঙ্গলের সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ, হবসের ভাষায়, জঙ্গলে সবসময় একটি বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে, অর্থাৎ সেখানে কোন কেন্দ্রিয় অথরিটি নেই যে জঙ্গলের প্রাকৃতিক আইন পরিবর্তন করবে। একইভাবে, প্রাকৃতিক পরিবেশে যেহেতু কোন কেন্দ্রিয় অথরিটি নেই, ফলে মানুষকে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং একইসাথে নিজের স্বার্থ আদায়ে সবসময় লড়ে যেতে হয়। এই প্রকৃতিতে কোন ব্যক্তিই তার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না সে যতই শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হোক। 
হবসের মতে, পরিস্থিতি যখন এরকম চ্যালেঞ্জিং, তখন কোন ব্যক্তির পক্ষে অবসরে যাওয়া বা সামাজিক সৌহার্দ্য বজায় রাখা বা মার্জিত আচরণ দেখানোর সময় থাকেনা। এহেন আচরণ মানুষের যৌক্তিক সিদ্বান্ত থেকে উদ্ভূত হয় যা তাকে নৈরাজ্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, জীবনে বেঁচে থাকার মন্ত্র তখন একটাই থাকে কিভাবে অন্য প্রতিযোগিদের পিছনে ফেলে নিজের স্বার্থকে সমুন্নত রাখা যায়, অর্থাৎ বর্বর প্রকৃতিতে টিকে থাকা যায়। নিজের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে তখন সেই ব্যক্তি সামাজিক চুক্তি করে এমন এক সত্তার সাথে যে হবসের ভাষায় সর্ব শক্তিমান ও চুড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী (Leviathan), আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যার নাম সার্বভৌম রাষ্ট্র। 
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি সহজেই প্রতীয়মান হয় যে কিভাবে প্রাক-সামাজিক পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বের, বিশেষ করে রিয়েলিজম বা বাস্তববাদ তত্ত্বের প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রিয়েলিজম তত্ত্বের অনুসারীরা জোর দিয়ে বলেন যে চূড়ান্ত শক্তি বা কেন্দ্রিয় সরকারের অনুপস্থিতিতেই সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশৃঙ্খলায় রূপ নেয়। 
তাদের ভাষায়, নৈরাজ্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক সিস্টেমে যখন কোন আইনের বালাই নাই, কোন শৃঙ্খলা নাই, সেখানে প্রতিটি রাষ্ট্রই চিরস্থায়ী নিরাপত্তা সংকটে (Security Dilemma) ভুগতে থাকে। কারণ, সেখানে দুর্বল রাষ্ট্র ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের সহজ শিকারে পরিণত হতে পারে; আবার দুর্বলরা একজোট হয়ে ক্ষমতাধরকে চ্যালেঞ্জও করতে পারে। ফলে, দুর্বল রাষ্ট্রগুলো এই Anarchic আন্তর্জাতিক সিস্টেমে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বা ক্ষমতাধরেরা নিজের জাতীয় স্বার্থ আদায়ের জন্য যেকোনো পন্থা গ্রহণে সর্বদা তৎপর থাকে। 
রিয়েলিজমের অনুসারীদের ভাষায়, নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তে এই যে চলমান তৎপরতা তা শক্তির (Power) সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ, শক্তি হল কেন্দ্রীয় নিয়ামক যা আন্তর্জাতিক সিস্টেমের বিদ্যমান নৈরাজ্য থেকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে অটুট রাখে। এক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তিরা অস্ত্রের বিস্তার ঘটায় যা নৈরাজ্যপূর্ণ সিস্টেম তাকে অধীক নিরাপত্তা প্রদান করে এবং নিজের জাতীয় স্বার্থ আদায়ের পথকে সহজ করে। আবার, ক্ষুদ্র দেশগুলো শক্তির সমীকরণে দুর্বল হওয়ায় নিজেদের বৃহৎ শক্তির বিপরীতে অনিরাপদ মনে করে এবং নিজেদের টিকে থাকার নিমিত্তে বৃহৎ শক্তির সাথে মৈত্রী গঠণ করে শক্তি ভারসাম্য অর্জনে চেষ্টা চালায়। 
-
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 


No comments