Header Ads

Header ADS

Balance of Power: আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান ভিত্তি

 
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিক্রমায় Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটি বহুল প্রচলিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটি একটি প্রতিসাম্য (Counter-balance) ব্যবস্থাকে ইঙ্গিত করে, যেখানে দুর্বল/কম শক্তিশালী রাষ্ট্র- কর্তৃত্ববাদী বা বৃহৎ শক্তির বিপরীতে নিজের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে বিবিধ কৌশল গ্রহণ করে। শক্তির ভারসাম্য রক্ষা একটি ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা। প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার যুদ্ধ, রোমান সাম্রাজ্যের সাথে অটোমানদের দ্বন্দ্ব, ইতালির নগর রাষ্ট্রে মেকিয়াভেলির শক্তি-অর্জন তত্ত্ব, এবং বিংশ শতকের দুটি মহাযুদ্ধ ইত্যাদি ভারসাম্যহীন শক্তি প্রদর্শনের সাথে সম্পর্কিত।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণে Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটি খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এই প্রাসঙ্গিকতার ডানায় ভর করে, পরবর্তী্তে,  আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম ফাউন্ডেশন তত্ত্ব- বাস্তববাদ (Classical Realism) ও নব্য-বাস্তবাদের (Neorealism) উন্মেষ ঘটে। এই বাস্তববাদী ও নব্য-বাস্তবাদীরা, Balance of Power বা শক্তিসাম্যকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন।  

১৯৪৮ সালে, প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, হ্যান্স জি মরগেন্থু তার বিখ্যাত পলিটিক্স এমং নেশন গ্রন্থে সর্বপ্রথম Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটির প্রকাশ ঘটান। বাস্তবাদীদের দৃষ্টিতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক  অনুধাবনে গ্রন্থটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মরগেন্থু বলেন, রাষ্ট্রগুলো যখন তাদের প্রত্যাহিক বিষয়ে Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটিকে মেনে নিয়ে একে অন্যের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে চাইবে, তখন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শক্তির সমতা আসবে। মরগেন্থুর ভাষায়, যদি আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটকে বিশ্লেষণ করি, তবে আমাদের বোধগম্য হবে যে Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটি একটি সর্বজনীন বিষয়, একটি ঐতিহাসিক প্রবণতা।

Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটির উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কারঃ দলীয় বা রাষ্ট্রীয় অথবা আন্তর্জাতিক স্তরে বিদ্যমান শক্তির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য বা স্থিতি তৈরি। বস্তুত, বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণে Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটির প্রাসঙ্গিকতা আরো জোরালো হয়, যখন নব্য-বাস্তবাদীরা (যেমনঃ কেনেথ ওয়াল্টজ ও জন মেয়ারশেইমার) ধারণাটির তাত্ত্বিক দিককে আরও কাঠামোবদ্ধ করেন। এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্ব- ইংলিশ স্কুল অব থটের অন্যতম প্রুধা হেডলি বুলও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধারা বিশ্লেষণে Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটিকে প্রাসঙ্গিক বলেছেন।   

নব্য-বাস্তববাদীরা Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারনাটিকে একটি তত্ত্ব হিসেবে উপস্থাপন করেন। নব্য-বাস্তববাদ তত্ত্বের বিখ্যাত তাত্ত্বিক Kenneth W. Waltz ‘র দৃষ্টিতে, Balance of Power বা শক্তিসাম্য তত্ত্ব হিসেবে প্রাথমিকভাবে দুটি কাজ করে। যথাঃ

(১) আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমন্ডলের বিশৃঙ্খল (Anarchic) পরিস্থিতি- আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মৌলিক একক, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সার্বিক আচরণের উপর কিরূপ প্রভাব ফেলে তা প্রকাশ করে; এবং

(২) আন্তর্জাতিক বিশৃঙ্খল (Anarchic) ব্যবস্থার অযুহাতে যদি কোন একক (কর্তৃত্ববাদী) রাষ্ট্র অন্যদের থেকে সামরিকভাবে বেশি শক্তিশালী হয়ে যায় বা হওয়ার চেষ্টা চালায়, তখন বাকি রাষ্ট্রের কী করতে হবে সে পথ বাতলে দেয়।

Balance of Power বা শক্তিসাম্য তত্ত্বানুসারে, এই সামরিক কর্তৃত্ববাদী (Hegemon) রাষ্ট্রের শক্তির বিপরীতে টিকে থাকতে হলে, অন্য রাষ্ট্রগুলো দুটি কাজ করতে পারে। যথাঃ

(১) নিজের সামরিক সক্ষমতাকে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, অথবা

(২) অনানুষ্ঠানিক (Informal) বা আনুষ্ঠানিক (Formal) সামরিক/রাজনৈতিক জোট (Alliance) গঠনের মাধ্যমে শক্তির ভারসাম্য তৈরি করতে পারে।


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে Balance of Power বা শক্তিসাম্যঃ
ধ্রুপদী বাস্তববাদ (Classical Realism) তত্ত্বের প্রখ্যাত তাত্ত্বিক হ্যান্স জি মরগেন্থু Balance of Power বা শক্তিসাম্যকে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মরগেন্থুর ভাষায়, বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সবসময় শক্তির উপর নির্ভর করে। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রই বিশ্ব রাজনীতির প্রধান সত্তা। রাষ্ট্রকে নিজের স্বার্থ আদায় বা টিকে থাকার নিমিত্তে শক্তি (সামরিক) বৃদ্ধি করতে হয়। এই শক্তি বৃদ্ধির প্রধান উদ্দেশ্য বৃহৎ শক্তিগুলোর মাঝে বা বিপরীতে শক্তির ভারসাম্য তৈরি করা। মরগেন্থু আরও বলেন, বহিঃশক্তির প্রভাবে বা প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে অথবা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কোন উপাদানের পরিবর্তনে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি যেকোনো রাষ্ট্রের স্বার্থ/নিরাপত্তা/টিকে থাকার ক্ষেত্রে নেতিবাচক বা হুমকিস্বরূপ। ফলস্বরূপ, রাষ্ট্রগুলোকে আবারও শক্তি ভারসাম্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা (Re-establishment) করতে হয়।

ভারসাম্য পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে, রাষ্ট্রগুলো কোন একক রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার সুযোগ হ্রাস করেন, কারণ এই কর্তৃত্বই পরবর্তীতে তাদের স্বাধীনতা ও টিকে থাকাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিবে বা দিতে পারে। হ্যান্স মরগেন্থু আরও বলেন, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের সবসময় শক্তিসাম্যকে মাথায় রাখতে হবে। বস্তুত, তাদের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় শক্তির বন্টন কিভাবে হচ্ছে, কে শক্তিশালী হচ্ছে, সেই শক্তি কাকে হুমকিতে ফেলছে, সিস্টেমের অংশ হিসেবে তার নিজের রাষ্ট্রীয় নীতিতে সেই শক্তি প্রদর্শন কতটা প্রভাব ফেলছে, কি আদৌ ফেলছে না প্রভৃতি বিষয়ে রাষ্ট্রের পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। শক্তি সম্পর্কিত এরূপ স্পষ্ট ধারণা রাষ্ট্রের স্বার্থ/নিরাপত্তা/টিকে থাকার সম্ভাবনাকে তরান্বিত করবে।    

নব্য-বাস্তবাদ (Neorealist) তত্ত্বের প্রখ্যাত তাত্ত্বিক কেনেথ ডাব্লিউ ওয়াল্টজ,  Balance of Power বা শক্তিসাম্য ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার Anarchy বা বিশৃঙ্খলা- নামক ধারণা দুটির মাঝে যোগসুত্র স্থাপন করেন। ওয়াল্টজের মতে, Balance of Power বা শক্তিসাম্য বিশ্ব রাজনীতির কোন অনলৌকিক বা সহজাত (Natural) বিষয় নয়, বরংঞ্চ, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার Anarchic বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকেই/ রোধের নিমিত্তেই শক্তির ভারসাম্য ধারণাটি বিকশিত হয়েছে। নব্য-বাস্তবাদীদের দৃষ্টিতে, আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্র একটি বিচক্ষণ সত্ত্বা (Rational Actor)। এই বিজ্ঞতা রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় নিজের প্রকৃত অবস্থান নির্ণয়ে সহায়তা করে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র-ক বুঝতে পারে আন্তর্জাতিক বিশৃঙ্খল ব্যবস্থায় যে মহাশক্তিধর/ কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র-খ রয়েছে, তার (খ-এর) বিপরীতে তাকে (ক-কে) স্বার্থ/ নিরাপত্তা/ টিকে থাকা নিশ্চিত করতে অবশ্যয়ই শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।  

কিন্তু রাষ্ট্র-ক যদি সামরিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে দুর্বল হয়, তবে কি সে (ক), রাষ্ট্র-খ এর বিপরীতে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে? অর্থাৎ, মহাশক্তির সাথে শত্রুতা সৃষ্টির ঝুঁকিকি সে (ক) নিবে? নব্য-বাস্তববাদ তত্ত্বের অপর প্রখ্যাত তাত্ত্বিক স্টিফেন এম ওয়াল্টের ভাষায়, যেহেতু রাষ্ট্র-ক একটি বিচক্ষণ সত্ত্বা (Rational Actor), সে অবশ্যয়ই মহাশক্তির (রাষ্ট্র-খ`র) রোসানলে পড়ার থেকে দূরে থাকবে। উপরুন্তু, রাষ্ট্র-ক, মহাশক্তি প্রবর্তিত পথে হেটেও ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্র-ক, রাষ্ট্র-খ`র লাঠিয়াল (Bandwagon) হিসেবে থাকতে চাইবে, বিনিময়ে রাষ্ট্র-খ প্রদত্ত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা (সামরিক বা অর্থনৈতিক) রাষ্ট্র-ক ভোগ করবে। এছাড়াও, স্টিফেন ওয়াল্ট বলেন, Balance of Power বা শক্তিসাম্যের প্রশ্ন তখনই উঠবে যখন উভয় রাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতায় তুলনামূলক পার্থক্য খুব কম থাকবে। স্নায়ুযুদ্ধকালীন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন শক্তিসাম্যের বড় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য।    

ইংলিশ স্কুল অব থট তত্ত্বের প্রখ্যাত তাত্ত্বিক হেডলি বুলের মতে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় Balance of Power বা শক্তিসাম্য এমন এক পরিস্থিতিকে ইঙ্গিত করে যেখানে কোন শক্তি/রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক সমাজের অন্য শক্তি/রাষ্ট্রের উপর চড়াও হবে না (No Preponderance), এবং উক্ত সমাজের বিভিন্ন আইন (Law) /আদর্শ (Norms) /প্রথার (Customs) বিপরীতে যাবে না, বরংঞ্চ আইন/আদর্শ/প্রথার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। হেডলি বুলের মতে, আন্তর্জাতিক সমাজে শৃঙ্খলা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যে পাঁচটি অনুষদ (Institutions) আবশ্যক, Balance of Power বা শক্তিসাম্য তাদের অন্যতম। হেডলি বুল Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটিকে দুইটি অংশে ভাগ করেন। যথাঃ

(১) সহজ ও জটিল শাক্তিসাম্য (Simple & Complex Balance of Power):
সহজ শক্তিসাম্য বলতে বুঝায়, যেখানে মাত্র দুটি রাষ্ট্র একে অন্যের সাথে শক্তির ভারসাম্য অর্জনে ব্যস্ত। যেমনঃ দক্ষিণ এশিয়ায়, ভারত পারমানবিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষার পরপরই পাকিস্তান পারমানকি অস্ত্র তৈরি করতে বাধ্য হয়। জটিল শক্তিসাম্য বলতে বুঝায়, যেখানে দুইয়ের অধিক শক্তিশালী দেশ নিজেদের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় ব্যস্ত। যেমনঃ প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরে চীনের নৌ-শক্তি বৃদ্ধির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান নৌ-জোট QUAD গঠনের মাধ্যমে নৌ-শক্তির ভারসাম্য অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছে।

(২) সাধারণ ও স্থানীয় শক্তিসাম্য (General & Local Balance of Power):
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় কোন কর্তৃত্ববাদ বা একক শক্তিশালী রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে শক্তির যেরূপ ভারসাম্য তৈরি হয় তাকে সাধারণ শক্তিসাম্য বলে। যেমনঃ স্নায়ুযুদ্ধকালে কোন হেজমন বা একক কর্তৃত্ববাদী শক্তির অনুপস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শক্তি ভারসাম্য অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিলো। স্থানীয় শক্তিসাম্য বলতে, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যকার শক্তির ভারসাম্যকে বুঝিয়ে থাকে। যেমনঃ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান, আঞ্চলিক পর্যায়ে, বিশেষত ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের শক্তিশালী অনুপ্রবেশ ভারতের স্বার্থের জন্য হুমকি। তাই অপর আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত, চীনের শক্তির বিপরীতে ভারসাম্য বজায় রাখতে নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে।   

Balance of Power বা শক্তিসাম্যের প্রায়োগিক দুর্বোধ্যতাঃ
নব্য-বাস্তববাদ তত্ত্বের দৃষ্টিতে, Balance of Power বা শক্তিসাম্যকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রে রাখতে হবে। কিন্তু কিভাবে ও কিসের ভিত্তিতে এই শক্তি নিরূপিত হবে? সেই প্রশ্নের উত্তরে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ নব্য-বাস্তবাদী তাত্ত্বিকেরা, কোন দেশের সামরিক সক্ষমতা, বাৎসরিক সামরিক ব্যয়, ও ব্যয় বহনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদিকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় শক্তি বন্টনের পরিমাপক হিসেবে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ, সামরিক সক্ষমতা, বাৎসরিক সামরিক বাজেট, ও বাজেট বাস্তবায়নে শক্ত অর্থনৈতিক ভিত প্রভৃতি স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বরাজনীতিতে একক রাজা হিসেবে আবির্ভুত হয়।  

যুক্তরাষ্ট্রের এই একক রাজত্ব Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারনাটিকে আঘাত করে। কারণ শক্তিসাম্য সবসময়ই শক্তির ভারসাম্য অর্জনে দ্বি-পাক্ষিক (Bipolar) বিশ্ব বা বহুপাক্ষিক (Multipolar) বিশ্বের কথা বলে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক এক-পাক্ষিক (Unipolar) বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে কিছু নব্য-বাস্তবাদী তাত্ত্বিক, এক-পাক্ষিক বিশ্বকে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু জন এফ মেয়ারশেয়মার তাদের যুক্তির সমালোচনা করেন।

মেয়ারশেইমার বলেন, Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারনাটি আবারও বিশ্ব রাজনীতিতে চাঙ্গা  হয়ে উঠবে; অতি শীগ্রই যুক্তরাষ্ট্রের এই একক রাজত্বের পতন ঘটবে; এবং শক্তিসাম্যের ভিত্তিতে সেই জায়গায় হয় দ্বি-পাক্ষিক বিশ্ব নতুবা বহু-পাক্ষিক বিশ্ব ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে। মেয়ারশেইমারের বিশ্লেষণকে আরও শক্ত করেছে প্রফেসর জন ইক্কেনবেরি। ইক্কেনবেরি বলেন, আঞ্চলিক শক্তি যেমন চীন, ভারত, ব্রাজিল ও রাশিয়া, এবং চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে উত্থানের ফলাফল সবগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে একটা বহু-পাক্ষিক শক্তিসাম্য অবস্থাকে নির্দেশ করছে।

Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটিকে নিয়ে সবচেয়ে মজার ও গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন ইংলিশ স্কুল অব থট তত্ত্বের প্রখ্যাত তাত্ত্বিক হেডলি বুল। তার মতে, আন্তর্জাতিক আইন সম্পূর্ণ রূপে শক্তিসাম্যের উপর নির্ভরশীল। এই ভারসাম্যের পুনঃস্থাপন (Re-establisment) সবসময়ই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জরুরী আইনগুলোতে পরিবর্তন নিয়ে আসে। অর্থাৎ, যদি যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে চীন বিশ্ব রাজনীতিতে কর্তৃত্ববাদী শক্তিতে পরিণত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবর্তিত ও প্রদর্শিত আন্তর্জাতিক আইনের একটা বড় অংশই বাদ পড়বে, এবং সেই জায়গায় চীনের দেখানো নিয়ম কানুন বা আদর্শ যুক্ত হবে।

হেডলি বুলের মতে, এইক্ষেত্রে উদীয়মান শক্তিকে কোনঠাসা করতে সামরিক শক্তির ব্যবহার প্রয়োজন পড়ে, বা অন্য রাষ্ট্রগুলো প্রায়শই সামরিক হস্তক্ষেপ চালিয়ে থাকে। যেমনঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক সামরিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের মিত্র ইসরাইল ও গালফভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ/নিরাপত্তা/টিকে থাকা ঝুঁকির মধ্যে পরে যায়। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ ও ইরাক যুদ্ধ (২০০৩) এর মাধ্যমে উদীয়মান শক্তি ইরাককে শক্তিহীন-দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। কিন্তু এই সামরিক হস্তক্ষেপ আইনগতভাবে অবৈধ ছিলো।

 অতএব, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যে তত্ত্বই হোক, Balance of Power বা শক্তিসাম্য ধারণাটি যে বিশ্ব রাজনীতিতে খুবই প্রাসঙ্গিক, এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিক্রমার গতি-প্রকৃতি অনুধাবনে খুবই প্রয়োজনীয় তা সহজভাবে স্বীকার করেছে।
 
অনুবাদকঃ
বদিরুজ্জামান
Key Concepts in International Relations
By: Thomas Diez and David Hudson
 
 

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.