Header Ads

Header ADS

জাতিসংঘের সমুদ্র বিষয়ক চুক্তির (UNCLOS) প্রেক্ষাপট




ডিসেম্বর ১০, ১৯৮২, শুক্রবার, বেলা দ্বিপ্রহর, সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রদূত টমি কোহের সভাপতিত্বে প্রণীত হয় সমুদ্র-সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কনভেনশন বা চুক্তি- UNCLOS। দীর্ঘ চব্বিশ বছরে (১৯৫৮-১৯৮২), UNCLOS শিরোনামে ধারাবাহিক তিনটি কনভেনশন বা চুক্তির (UNCLOS-১, UNCLOS-২, ও UNCLOS-৩) বদৌলতেই জাতিসংঘের সমুদ্রস-সংক্রান্ত কনভেনশন আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়।

UNCLOS শিরোনামে   উপরিউক্ত চুক্তিগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলোঃ ১৯৫৮ সালের Convention on the High Seas বা আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত চুক্তির প্রতিস্থাপন। বদলে, UNCLOS উক্তস্থানে এমন একটি পরিকল্পিত ও সর্বাঙ্গীণ আইন/নীতি-কাঠামো উপস্থাপন করবে, যা সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। পাশাপাশি UNCLOS, এই নীতি বাস্তবায়ণের জন্য বেশ কিছু কার্যকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি কথা বলে, যারা সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিটি সমুদ্র-তীরবর্তী দেশকে UNCLOS`র আইনী নির্দেশণা পালণে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করবে।

UNCLOS ১৯৮২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপিত হলেও, সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হতে কমপক্ষে ৬০টি রাষ্ট্রের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। অনশেষে, নভেম্বর ১৬, ১৯৯৪, UNCLOS সেই শর্ত-পূরণে সক্ষম হয়, এবং সমুদ্র-সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কনভেনশন হিসেবে আত্ম-প্রকাশ করে। ১৯৮২-২০২২ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ ১৬৮ টি রাষ্ট্র কনভেনশনটিকে অনুমোদন প্রদান করেছে।  

রাজনৈতিক, সামরিক বা অর্থনৈতিক বিবিধ অজুহাতে, কতিপয় বৃহৎশক্তি যেমনঃ অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, আইসল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া, UNCLOS কনভেনশনটির অনুমোদন দেয়নি। চুক্তিতে এই রাষ্ট্রগুলোর অনেকে স্বাক্ষরই করেনি।
 বস্তুত, উক্ত দেশগুলোর অননুমোদন UNCLOS চুক্তিটির গ্রহণযোগ্যতাকে কোন অংশে কমিয়ে দেয় নি। কারণ, আন্তর্জাতিক অপরাধ-বিষয়ক চুক্তি- জেনেভা কনভেনশন, ১৯৫১`র মতন- UNCLOS প্রদত্ত আইনী কাঠামোটিও একটা সর্বজনীন আইন। তাই, ব্যবহারিক দিক থেকে এই রাষ্ট্রগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে UNCLOS`র অনুচ্ছেদগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচারণ করতে দেখা যায়।  
 
UNCLOS গঠনের পটভূমিঃ
ঐতিহাসিকভাবে সমুদ্রকে (সাগর ও মহাসাগর) বিশ্লেষণে বিভিন্ন (Doctrine) মতবাদের প্রয়োজন পড়েছে। সপ্তদশ শতকের স্বাধীন-সমুদ্র মতবাদটি (the freedom of-the-seas doctrine) আধুনিক রাষ্ট্রকে সমুদ্র সম্পর্কে আরও সচেতন করে তোলে। স্বাধীন-সমুদ্র মতবাদটি সমুদ্র-তীরবর্তী দেশগুলোকে সমুদ্রের সীমারেখা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটি পরিষ্কার নির্দেশনা প্রদান করে। এখানে সমুদ্র-তীরবর্তী দেশগুলোকে, সমুদ্রের সীমারেখা নির্ণয়ে সার্বভৌমত্ব বা রাজনৈতিক অধিকারের পরিধিকে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়। অর্থাৎ, পূর্বে শক্তিশালী সমুদ্র-তীরবর্তী দেশগুলো যে পরিমান সমুদ্রসীমাকে নিজেদের বলে দাবী করতো, আইনের ভিত্তিতে সেই দাবীতে লাগাম টানতে হবে। ফলে, রাজনৈতিক সমুদ্রসীমার বাইরে যে বিরাট গভীর সমুদ্র থাকবে, সেই অংশটি (গভীর/খোলা সমুদ্র= Deep/High Sea) কোন একক দেশের নয়, বরং সবার। সেখানে কোন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বে-আইনি হিসেবে বিবেচিত হবে।  

কিন্তু ঊনবিংশ শতকে শেষ ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে, যখন ব্রিটিশ ও যুক্তরাষ্ট্র সামুদ্রিক গবেষণা চালিয়ে সমুদ্র-তলে গুরুত্বপূর্ণ বিবিধ প্রাকৃতিক সম্পদের হদিস দেন, তখন থেকে পূর্বের নির্ধারিত সীমানাকে বর্ধিত করা নিয়ে অন্যান্য দেশগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আধুনিক মাছ-ধরা জাহাজের সাহায্যে বেশি বেশি মাছ শিকারের সম্ভাবনা; সামুদ্রিক পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্যাংকার থেকে নির্গত হওয়া তেল ও বিষাক্ত বর্জ পদার্থ; সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ আবিষ্কার ও সমুদ্রকে ব্যবহার করে বিশ্ব বাজারের সাথে নিজেদেকে যুক্তকরণ প্রভৃতিকে সামনে রেখে দেশগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক সীমানা বর্ধিতকরণের দাবী আরও জোরালো হয়ে ওঠে।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্যপক আকারের শিল্পায়ণ, এবং ফলাফল হিসেবে সমুদ্র দূষণ ও সামুদ্রিক জটিল বাস্তুসংস্থানের উপর নেতিবাচক প্রভাব বৃদ্ধি; বিশ্ব বাজারের মাছ রপ্তানির মাধ্যমে মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে অন্য দেশের সীমানাভুক্ত সমুদ্র সীমা ও গভীর সমুদ্র থেকে মাছ শিকার; সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর, সমুদ্রতলের সম্ভাব্য প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই; সমুদ্রতলের সংবেদনশীল প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা; বিশ্ব-রাজনীতিতে নিজেদের প্রভুত্ব বজায় রাখতে ক্রমাগত নৌ-শক্তি বৃদ্ধি, এবং কৌশলগত বিভিন্ন সামুদ্রিক জায়গার উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৌ-সামরিক জোট তৈরি; প্রভৃতি ঝুঁকির জন্য, ভূখন্ডের মতন সমুদ্রও অস্থির ও সংঘাতপূর্ণ জায়গায় রূপ নেয়। ফলে, স্বাধীন-সমুদ্র মতবাদটি যে বিংশ শতকের জন্য অকেজো তা প্রমাণিত হয়।   

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শিল্প-কারখানা চালু রাখতে প্রচুর প্রাকৃতিক তেল ও গ্যাসের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৪৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী সমুদ্রসীমার বাহিরে, বিশেষত সমুদ্রের মহীসোপান অঞ্চলে প্রথমবারের মতন প্রাকৃতিক তেল, গ্যাস ও খনিজ পদার্থ উত্তোলন শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্বেচ্ছাচারী আচারণ স্বাধীন-সমুদ্র মতবাদের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিলো।  অক্টোবার ১৯৪৬, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ হিসেবে আর্জেন্টিনা প্রথম মহীসোপান অঞ্চলকে নিজের রাজনৈতিক সীমা হিসেবে ঘোষণা দেয়।  

আর্জেন্টিনার পথ ধরে, ১৯৪৭ সালে চিলি ও পেরু; এবং ১৯৫০ সালে ইকুয়েডোর তাদের সমুদ্রতীর হতে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রসীমাকে নিজেদের সার্বভৌম অঞ্চল হিসবে দাবী করেন। ক্রমশয়ই দাবীদার দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫০`র দশকে মিশর, ইথিওপীয়, সৌদি আরব, লিবিয়া, ভেনেজুলিয়া, ও পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ তাদের সমুদ্রতীর হতে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সামুদ্রিক জায়গাকে নিজেদের রাজনৈতিক সমুদ্রসীমা হিসেবে ঘোষণা দেয়। এই দাবী/ ঘোষণা স্বাধীন-সমুদ্র মতবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, কারণ মতবাদটি প্রতিটি সমুদ্র তীরবর্তী দেশকে তীর হতে ৩ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত রাজনৈতিক সমুদ্রসীমা ব্যবহারের অধিকার দিয়েছিলো।  

স্বাধীন-সমুদ্র মতবাদটি বেশি জটিলতার মধ্যে পরে যখন কিছু দ্বীপ রাষ্ট্রও একই ধরণের দাবী জানায়। যেমনঃ প্রায় তের হাজার দ্বীপ সম্মিলিত রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া তার প্রতিটি দ্বীপের জন্য আলাদাভাবে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবী জানান; ফিলিপাইনও একই পথে হাটেন। ১৯৭০ এ, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র কানাডা, আর্কটিকের জলরাশ্মিকে দূষণ থেকে বাচাতে, সমুদ্রতীর হতে ১০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্র সীমাকে নিজেদের রাজনৈতিক সীমা হিসেবে ঘোষণা দেয়।

শিল্পায়ন বৃদ্ধির সাথে সাথে সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত বিবিধ প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের চাহিদা বাড়তে থাকে। যেমনঃ ১৯৬০`র দশকে তেল সম্পদ আহরণের জন্য সমুদ্রের মহীসোপান অঞ্চলে গভীর থেকে গভীরতর খনন কার্জ চালানো হয়। মেক্সিকো উপসাগরে প্রথম এই খনন কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে খনন কাজের তীব্রতা বাড়তেই থাকে। ১৯৫৪ সালে যেখানে সাধারণ খননের ফলে মাত্র অর্ধ-মিলিয়ন টন তেল আহরণ করা হয়েছিল, গভীর খননের ফলে ১৯৬০ সালের মধ্যে সেখান থেকে উত্তলিত তেলের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন।
 
UNCLOS-I: জাতিসংঘের সমুদ্র-বিষয়ক প্রথম সম্মেলন
সমুদ্রতলের সম্ভাব্য বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ অধিকারের জোরালো দাবীর ভিত্তিতে, সামুদ্রিক জীব ও সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ, এবং প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের অভ্যন্তরীন বাজার সম্প্রসারণ ও তার জ্বালানি চাহিদা পূরণে যুক্তরাষ্ট্রের মহীসোপান অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ইত্যাদি জাতিসংঘকে সমুদ্র বিষয়ক স্বাধীন-সমুদ্র মতবাদের পরিবর্তে, নতুন ধরণের আইনী কাঠামো তৈরির ব্যাপারে চিন্তিত  করে তোলে। ফলাফল হিসেবে ১৯৪৭ সালে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৭৪ নম্বর রেজুলেশন পাশ করে, যেখানে একটি আন্তর্জাতিক আইন কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।  

এই কমিশনের উদ্দেশ্য ছিলো দুটিঃ
(ক) আন্তর্জাতিক আইন অধিভুক্ত নীতির সম্প্রসারণ, এবং
(খ) আন্তর্জাতিক পাবলিক/সরকারি আইন ও আন্তর্জাতি প্রাইভেট/বেসরকারি আইনের বিবিধ সমস্যার সমাধান প্রদান।

১৯৪৯ সালে, আইন কমিশনকে আন্তর্জাতিক সমুদ্র-সংক্রান্ত আইন সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। জে পি ও ফ্রান্সিওকে (High Sea) গভীর সমুদ্র-সংক্রান্ত নীতি পর্যাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিশনের অধীনে ১৯৪৯-১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মোট আটটি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক আইন কমিশন ১৯৫৬ সালের শেষার্ধে সমুদ্র-সক্রান্ত আইনি অনুচ্ছেদ  শিরোনামে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক সমুদ্র-সংক্রান্ত আইনের খসড়া জমা দেন। খসড়ার ভিত্তিতেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের সমুদ্র-সংক্রান্ত প্রথম সম্মেল্নটি আয়োজন করেন।    

ফেব্রুয়ারি ২৪, ১৯৫৮, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের সমুদ্র-বিষয়ক প্রথম সম্মেলনটি (UNCLOS-১) অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ছিয়াশিটি দেশ অংশগ্রহণ করে। UNCLOS-১ সম্মেলনে সফল্ভাবে চারটি সমুদ্র-বিষয়ক কনভেনশনের সাথে সংঘাত সমাধান শিরোনামে একটি অতিরিক্ত প্রটোকল গৃহীত হয়। যথাঃ
(ক) সমুদ্রের রাজনৈতিক ও তীর-সংলগ্ন সীমা নির্ধারণী কনভেনশন (The Convention on the Territorial Sea and the Contiguous Zone);
(খ) গভীর সমুদ্র-বিষয়ক কনভেনশন (The Convention on the High Seas);
(গ) সমুদ্রের মহীসোপান অঞ্চলের সীমা নির্ধারণী কনভেনশন (The Convention on the Continental Shelf);
(ঘ) গভীর সমুদ্রের মৎস্য ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত কনভেনশন (The Convention on Fishing and Conservation of the Living Resources of the High Seas); এবং
(ঙ) সমুদ্রিক সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রটোকল (The Optional Protocol of Signature Concerning the Compulsory Settlement of Disputes)।

এবাদেও, UNCLOS-১`র অধীনে আলাদাভাবে নয়টি রেজুলেশন পাশ করা হয়। যথাঃ
Ø  গভীর সমুদ্রে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা সংক্রান্ত রেজুলেশন;
Ø  তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রভাবে গভীর সমুদ্রের দূষণ সংক্রান্ত রেজুলেশন;
Ø  মৎস্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত রেজুলেশন;
Ø  সংরক্ষণী পদক্ষেপে সহযোগি হিসেবে অংশগ্রহণ সংক্রান্ত রেজুলেশন;
Ø  মানব প্রয়োজন পূরণে সামুদ্রিক জীবন ধ্বংস সংক্রান্ত রেজুলেশন;
Ø  উপকূলীয় মৎস্য আহরণ ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত রেজুলেশন;
Ø  ঐতিহাসিক জলসীমা সংক্রান্ত রেজুলেশন;
Ø  জাতিসংঘের সমুদ্র-বিষয়ক দ্বিতীয় সম্মেলনের আয়োজন সংক্রান্ত রেজুলেশন; এবং
Ø  আন্তর্জাতিক আইন কমিশনকে স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত রেজুলেশন।

UNCLOS-১ এ সমুদ্রকে তিনটি অংশে বিভক্ত করা হয়। যথাঃ অভ্যন্তরীণ জলসীমা (Internal Waters), রাজনৈতিক জলসীমা (Territorial Waters) এবং গভীর সমুদ্র (High Seas)। UNCLOS-১`র সমুদ্রের রাজনৈতিক ও তীর-সংলগ্ন সীমা নির্ধারণী কনভেনশনের প্রথম অনুচ্ছেদেই অভ্যন্তরীণ জলসীমা ও রাজনৈতিক সমুদ্র সীমার উপর সমুদ্র-তীরবর্তী রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি গভীর সমুদ্রকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

মহীসোপান সংক্রান্ত কনভেনশনের ১(১) অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক সমুদ্রসীমার শেষে সর্বনিম্ন ২০০ মিটার থেকে শুরু করে তারও অধিক গভীরের অংশকে মহীসোপান অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ, সাবমেরিন স্বাভাবিক যে গভীরতায় চলতে পারে তাকে মহীসোপান অঞ্চল নির্ধারণের সর্বনিম্ন একক হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু তীর থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপান অঞ্চল নির্ধারিত হবে, এবং ১২ নটিক্যাল মাইলের পরের সমুদ্র অঞ্চল গভীর সমুদ্র হিসেবে বিবেচিত হবে।
 
UNCLOS-II: জাতিসংঘের সমুদ্র-বিষয়ক দ্বিতীয় সম্মেলণ
মার্চ ১৭, ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের সমুদ্র-সংক্রান্ত দ্বিতীয় সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের আলোচ্যসূচি ছিলো প্রধানত দুটি। যথাঃ (ক) রাজনৈতিক সমুদ্রসীমার (Territorial Waters) বাইরের অঞ্চল নির্দিষ্ট করণ, এবং (খ) রাজনৈতিক সমুদ্রসীমার কতটুকু অঞ্চলব্যাপী মাছ শিকার করা যাবে তা নির্ধারণ। প্রথম সম্মেলনের মতন, দ্বিতীয় সম্মেলনেও প্রায় ছিয়াশিটি রাষ্ট্র উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বিবিধ দাবী ও অজুহাতের ফলে সম্মেলনের কোন সমাধান আসছিলো না। অবশেষে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পক্ষ থেকে যৌথভাবে প্রস্তাব দেয়া হয়।

প্রস্তাবে রাজনৈতিক সমুদ্রসীমাকে ৩ নটিক্যাল মাইল থেকে বাড়িয়ে ৬ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত করা; এবং ৬ নটিক্যাল মাইল রাজনৈতিক সীমার বাহিরেও অতিরিক্ত ৬ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রসীমাকে মৎস্য আহরণ অঞ্চল (Exclusive Fishery Zone) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।   তবে, গভীর সমুদ্রের মৎস্য সংরক্ষণ নীতি বাস্তবায়ণে, সমন্বিত সিদ্বান্তক্রমে দশ বছর পর্যন্ত উক্ত অঞ্চলে মাছ ধরা স্থগিত ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু, যৌথ প্রস্তাবটি অন্যান্য রাষ্ট্র মেনে নেয়নি, এবং প্রস্তাবটি বাতিল হিসেবে গণ্য করা হয়। এভাবেই, জাতিসংঘের সমুদ্র-বিষয়ক দ্বিতীয় সম্মেলনটি একধরনের অচলাবস্থার মধ্যদিয়ে শেষ হয়।
 
UNCLOS-III: জাতিসংঘের সমুদ্র-বিষয়ক তৃতীয় সম্মেলন
নভেম্বর ১, ১৯৬৭, জাতিসংঘে নিযুক্ত মালটার স্থায়ী সদস্য অরবিদ পারদো, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সকল রাষ্ট্র প্রধানদের উদ্দেশ্যে বলেন পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন সংঘাত ও সামরিক প্রতিযোগিতার ফলে সমুদ্র ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পারদোর মতে, সমুদ্র মানুষের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণকালে পারদো বলেন, যেভাবে সমুদ্রকে দখল নিয়ে মহাশক্তিদের মাঝে রেশারেশি চলছে, যেভাবে বিষাক্ত পদার্থে সমুদ্রকে ভরে ফেলা হচ্ছে; যেভাবে সমুদ্র তলের লুকিয়ে থাকা সম্পদ আহরণকে নিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে, তা খুব শীগগির স্বাধীন সমুদ্রকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করবে।  

আরভিদ পারদো  তার বক্তব্যের শেষাংশে বলেন, চলুন, আমরা এমন একটি কার্যকরি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করি, যা রাজনৈতিক ও গভীর সমুদ্রসীমার তলদেশ নিয়ে কাজ করবে। এই সংস্থাটিই হতে পারে সমুদ্রতলের সম্পদ আহরণ নিয়ে দ্বন্দ্বের এক বিকল্প সমাধান। সংস্থাটি হতে পারে সমুদ্রতল ও সমুদ্রতলের সম্পদের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে এক সেতু বন্ধন।

এম্বাসেডর অরবিদ পাদরো এমন এক সময় আহবানটি জানান যখন বেশিরভাগ সমুদ্র তীরবর্তী দেশ ধ্রুপদী স্বাধীন-সমুদ্র মতবাদটির হালনাগাদের প্রয়োজনীয়তাকে এক বাক্যে স্বীকার করেন নেন। পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সমুদ্রকে নতুনভাবে জানতে দেশগুলোকে আরও কৌতূহলী করে তোলে। অরবিদ পাদরোর বক্তব্যের পরোক্ষ প্রভাবে জাতিসংঘে সমুদ্র-সংক্রান্ত বেশ কিছু পদক্ষেপ দেখা যায়। যথাঃ  

(ক) সমুদ্রতল সংক্রান্ত সিদ্বান্তের দীর্ঘ ১৫ বছরের অচলাবস্থার পালে হাওয়া লাগে;
(খ) জাতিসংঘের অধীনে সমুদ্রতল-বিষয়ক কমিটি তৈরি করা হয়;
(গ) সমুদ্রতলে কোনো ধরণের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞা প্রদান সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়;
(ঘ) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক রাজনৈতিক সমুদ্রসীমার বাহিরের সমুদ্রতল ও সমুদ্রতলের লুকায়িত বিবিধ প্রাকৃতিক সম্পদকে মানবজাতির সাধারণ ঐতিহ্য/সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়; এবং
(ঙ) সুইডেনের স্টোকহোমে মানব পরিবেশ শিরোনামে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক, বিশেষত সমুদ্র সংক্রান্ত সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।  

জাতিসংঘের সমুদ্রতল- বিষয়ক কমিটি আন্তর্জাতিক মহলে বিভিন্ন কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে শুরু করে। কারণ, এই কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই সমুদ্র তীরবর্তী দেশের অনুমোদন নিয়ে সমুদ্রের সমগ্র অঞ্চল ও এই অঞ্চলের জীব ও প্রাকৃতিক সম্পদ কেন্দ্রিক বিবিধ নিয়ম-কানুন তৈরি করা সম্ভব হয়। এভাবেই জাতিসংঘের সমুদ্র-বিষয়ক তৃতীয় সম্মেলনটি, অন্য দুটি সম্মেলনের তুলনায় বেশি সফল ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। অবশেষে, সমুদ্র বিষয়ক একটি সর্বাঙ্গীণ কনভেনশন/ চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়।  

জাতিসংঘের সমুদ্র-সংক্রান্ত তৃতীয় সম্মেলনটি আয়োজিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে, নিউইয়র্কে। এই সম্মেলন দীর্ঘ নয় বছর চলে। দীর্ঘ নয় বছরে, ১৬০ টির বেশি স্বাধীন রাষ্ট্র দফায় দফায় আলোচনার টেবিলে বসে; এবং সমুদ্রের কতটুকু সীমারেখায় তাদের সার্বভৌমত্ব বজায় থাকবে তা নিয়ে দরকষাকষি করে। অবশেষে, ১৯৮২ সালে, জাতিসংঘের সমুদ্র-সংক্রান্ত আইনি কনভেনশন গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে সম্মেলনটি শেষ হয়।
 
 
 
 
 
রেফারেন্সঃ
·       https://www.curtis.com/glossary/public-international-law/unclos
·       https://www.imo.org/en/ourwork/legal/pages/unitednationsconventiononthelawofthesea.aspx
·       http://www.continentalshelf.org/about/1143.aspx
·       http://iilss.net/the-first-un-conference-on-the-law-of-the-sea-1958/
·       https://wcl.american.libguides.com/c.php?g=563260&p=3877789
·       https://legal.un.org/diplomaticconferences/1960_los/
·        
 


বদিরুজ্জামান
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।  


No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.