Header Ads

Header ADS

গ্যাটের (GATT): আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার

 

GATT to WTO


আন্তজার্তিক রাজনীতির ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তর্কসাপেক্ষে এই শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসই বদলে গেছে, জন্ম হয়েছে ৭০ এরও অধিক নতুন জাতিরাষ্ট্রের, ভেঙে গেছে অধিকাংশ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক কলোনীগুলো, রাজনীতি এবং সরকার ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন। পরিবর্তন শুধু রাজনৈতিক পরিমন্ডলেই আসেনি, বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং অর্থনীতিতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে শুধুমাত্র ইউরোপীয় কিছু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোই পৃথিবীর নানা প্রান্তে কলোনী স্থাপন করে কিংবা নৌপথে বাণিজ্য পরিচালনা করে আর্থিক শক্তির জানান দিতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কলোনীগুলো যেমন স্বাধীন হয়ে যায়, একই সাথে প্রয়োজন পড়ে আধুনিক বিশ্ববাণিজ্যে নানা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, ও বাণিজ্যিক সংগঠনের, একই সাথে নানা আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার।

GATT সেরকমই একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ছিলো।


গ্যাটের উৎপত্তির পটভূমিঃ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের অর্থনীতিতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলে। জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি সহ অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোই সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ভয়াবহ অবস্থা, একই সময়ে ইউরোপীয় কলোনী গুলোর স্বাধীনতা অর্জন, এবং পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের উত্থান, সব মিলিয়ে আন্তজার্তিক বাণিজ্যে এবং অর্থনীতিতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোয় একপ্রকার ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসে।

এ থেকে ইউরোপের পুনর্গঠন, সংস্কারের লক্ষেই বেশকিছু আঞ্চলিক ও আন্তজার্তিক সংগঠন গড়ে ওঠে৷ যেমনঃ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইত্যাদি।

কিন্তু ইউরোপের পুনর্গঠনে ইউরোপের যেমন মাথাব্যথা ছিলো, একই সাথে তৎকালীন উঠতি পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও সাহায্য করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচনায় আসার ইচ্ছে ছিলো। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৪ সালের জুলাই এর ১-২২ তারিখ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে নিউ হ্যাম্পশায়ার, ব্রেটন উডসে ৪৪টি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। কনফারেন্সের মূল বিষয়বস্তু ছিলো যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি, বাণিজ্য, ও ব্যবসায় নতুন নীতিমালা প্রণয়ন, নয়া আন্তজার্তিক অর্থনৈতিক সংগঠন সৃষ্টি ও সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। বলাই বাহুল্য, কলোনী হারানোর পর এইসকল সংস্থা ও সংগঠনগুলোই পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থ রক্ষার এবং ইউরোপীয় মানদণ্ড আন্তজার্তিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এবং আইএমএফ কে অনুমোদন দিলেও বাণিজ্যের জন্য আলাদা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থা (ITO) কে অনুমোদন দেয়নি।

পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের ৩০শে অক্টোবর, সুইজারল্যান্ডের জেনেভার প্যালেইস দে ন্যাশনে দীর্ঘ ৬ মাসব্যাপী আলাপ-আলোচনার পর ২৩ দেশের বহুপাক্ষিক চুক্তি সাক্ষরের মাধ্যমে গ্যাট (General Agreements on Tariffs and Trade) আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এই চুক্তি সাক্ষরকৃত ২৩টি দেশই গ্যাটের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রাষ্ট্র।

গ্যাটের মূল লক্ষ্য ছিলো আন্তজার্তিক বাণিজ্যে শুল্ক সহ অন্যান্য বাধাসমূহ দূর করা, এবং বাণিজ্যের মধ্যস্থতাকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করা। গ্যাট মূলত বাণিজ্যিক পণ্য, পণ্য সরবরাহ ইত্যাদির নীতিমালা নিয়ে কাজ পরিচালনা করতো।

 

গ্যাটের বৈঠক বা রাউন্ডসমূহঃ

গ্যাট বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পূর্ববর্তী আন্তজার্তিক সংগঠন, যা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত টিকে ছিলো। জেনেভা ভিত্তিক এ সংগঠনটির মোট ৮টি বৈঠক বা রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়। এবং, ৮ম রাউন্ডে এই সংগঠনটির বিলুপ্তি ঘটে।

গ্যাটের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়।

দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালে, ফ্রান্সের এনেসি তে।

তৃতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের টরকোয়ে।

চতুর্থ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৬ সালে, আবারো সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়।

এরপর থেকে বৈঠকগুলোকে রাউন্ড হিসেবে গণনা করা শুরু হয়, যেমনঃ

পঞ্চম রাউন্ডঃ ১৯৬০-৬১ (ডিলন রাউন্ড)

ষষ্ঠ রাউন্ডঃ ১৯৬৪-১৯৬৭ (কেনেডি রাউন্ড)

সপ্তম রাউন্ডঃ ১৯৭৩-১৯৭৯ (টোকিয়ো রাউন্ড)

গ্যাটের অষ্টম রাউণ্ড অনুষ্ঠিত হয় উরুগুয়েতে, যা ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত চলে। একে উরুগুয়ে রাউণ্ডও বলা হয়।

 

গ্যাট থেকে ডব্লিউটিওঃ

গ্যাট ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সফল কোন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত সংগঠন। গ্যাট প্রথমে বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্কজনিত বাঁধা দূর করতে সাহায্য করে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথম রাউন্ডে গ্যাট প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের শুল্ক হ্রাস করতে সমর্থ হয়। তৃতীয় রাউন্ডে এসে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫% এ। পঞ্চম রাউন্ডে (ডিলন রাউন্ড) গ্যাট সদ্য প্রতিষ্ঠিত EEC (European Economic Community) ও EFTA এর সাথে শুল্কবিষয়ক বাণিজ্যিক চুক্তি করে, অন্যদিকে এই রাউন্ডেই প্রথমবারের মতন আইটেম বাই আইটেম ট্যারিফ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

পরবর্তীতে কেনেডি রাউণ্ডে (ষষ্ঠ) গ্যাট বহুপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতি সংস্কারের জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নামানুসারে এই রাউণ্ডের নাম কেনেডি রাখা হয়। এই রাউণ্ডে মূলত ৩ টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ঃ

১. উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির জন্য বাণিজ্য আরো সহজ করে তোলা, ও সম্প্রসারণ।

২. শুল্ক সহ সকল প্রকার বাঁধা হ্রাস ও প্রয়োজনে নির্মূল করা। (৫০% হ্রাসকরণ)

৩. কৃষিজ পণ্যের ক্ষেত্রে আন্তজার্তিক বাজারে প্রবেশের সুবিধা।

উক্ত রাউন্ডে রাসায়নিক, ও শিল্পজাত পণ্যে ৩৫% পর্যন্ত শুল্কহ্রাসের সিদ্ধান্ত হয়। অন্যদিকে, কৃষি ও খাদ্যদ্রব্যে ১৫% ও ১৮% শুল্ক হ্রাস করা হয়।

 কেনেডি রাউন্ডের আরেকটি বড় সাফল্য হচ্ছে, এই বৈঠকে এন্টি ডাম্পিং পলিসি গ্রহণ করা।

সর্বশেষ উরুগুয়ে রাউণ্ড ছিলো গ্যাটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাউণ্ড। প্রায় ৮ বছরের অধিক সময় ধরে চলা এই রাউণ্ডে বাণিজ্যের বিভিন্ন বিষয়, মাত্রা, এবং বিভিন্ন ধরণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। উরুগুয়ে রাউন্ডের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, কৃষি বিষয়ক চুক্তি, যা বিশ্ববাণিজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কৃষি বাণিজ্য উদারনীতির উদাহরণ। কৃষিজ পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করা, ভর্তূকি, কৃষিজ পণ্যের কোটা, ইত্যাদি।

গ্যাট যখন যাত্রা শুরু করে তখন বাণিজ্যে শুল্কের পরিমাণ ছিলো ২২%, যা উরুগুয়ে রাউণ্ডে ৫% নেমে আসে।

কিন্তু তারপরেও গ্যাটের বেশকিছু সীমাবদ্ধতা ছিলো, যার ফলে অষ্টম রাউন্ডেই সংগঠনটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি WTO বা World Trade Organization দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।

 

গ্যাটের সীমাবদ্ধতা ও বিলুপ্তিঃ

গ্যাট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাণিজ্যভিত্তিক প্রথম সংগঠন, এর পূর্বে পৃথিবীতে সেরকম কোন সংগঠনও ছিলো না, ছিলো না বিধিনিষেধ। যার ফলে প্রায়শই বাণিজ্য বিস্তার নিয়ে দেশে দেশে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, ও যুদ্ধ লেগে যেতো।

বিশ্বযুদ্ধের পর তাই, এরকম সংকট মোকাবিলায়, এবং সহজে আন্তজার্তিক বাণিজ্য বিস্তারে গ্যাটের আবির্ভাব ঘটে।

গ্যাটের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা ছিলো যে, সংগঠনটি শুধুমাত্র বাণিজ্যিক পণ্য নিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করতো, তাও সকল পণ্য নয়। যার ফলে অন্যান্য অর্থনৈতিক বিষয়ে তখনও সংঘাত চলমান ছিলো। পরবর্তীতে কৃষিজ পন্য বাণিজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, গ্যাটে অধিকাংশ রাষ্ট্র না থাকায় এবং প্রশাসনিক কাঠামো শক্ত না হওয়ায়- কোন নীতি বা আইনেরই আন্তজার্তিকীকরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

মূলত গ্যাট ছিলো শিল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মধ্যকার একপ্রকার সেতু, যা বিভিন্ন আইন কানুন ও নীতিমালা প্রণয়ন করে কেবল বাণিজ্যের বিভিন্ন সমস্যা ও বাঁধা দূর করতে সাহায্য করবে।

অন্যদিকে, সেবা খাত, চ্যারিটি, Intellectual Property Rights, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বত্ব, ইত্যাদি বিষয়েও কোন নীতিমালা ছিলো না গ্যাটে৷

যার ফলে উরুগুয়ে রাউণ্ডে এসকল বিষয় বিবেচনা করে, ১৯৯৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর উরুগুয়ে রাউণ্ডের "Final Act" গৃহীত হয়,

এরপর ১৯৯৪ সালের ১৫ই এপ্রিল, মরক্কোর মারাকেশে, ১২৩টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গের উপস্থিতিতে এই চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই ফাইনাল এক্টের অধীনে ২৯ টি চুক্তি ছিল যা WTO এর ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিলো ৭৫৫০টি।

পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে WTO কার্যক্রম শুরু করে, এবং গ্যাটের বিলুপ্তি ঘটে।

 

 

-        মুহাম্মদ ইরফান সাদিক

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.