 |
GATT থেকে WTO |
GATT থেকে WTO: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিকাশের ধারা
গল্পের সূচনা সেই বিংশ শতকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বীভৎস রূপ, প্রথমবারের মত, ইউরোপীয়দের ইউরোপের যুদ্ধ কেন্দ্রিক কালচার (যেমনঃ ফ্রান্স বনাম ব্রিটেন, ফ্রান্স বনাম জার্মানি, জার্মানি বনাম রাশিয়া, রাশিয়া বনাম অটোমান সাম্রাজ্য ইত্যাদি) যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সে সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের উদ্দেশ্য পরিচালিত প্রতিটি যুদ্ধ যে দেশ বা অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে একদম তলানিতে নিয়ে ফেলতে পারে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা ইউরোপীয়দের সম্মুখে সে দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যাকে ইউরোপের/ বৈশ্বিক ইতিহাসে 'মহাযুদ্ধ' নামে আখ্যা দেওয়া হয়, ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তিকে (যেমনঃ ফ্রান্স ও ব্রিটেন) অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়।
আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এই মহাযুদ্ধের বিজেতারা (ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান ইত্যাদি) পরাজিত (জার্মান, অস্ট্রো-হাংগেরিয়ান, অটোমান সাম্রাজ ও চীন প্রভৃতি) পক্ষকে ইচ্ছে ও প্রয়োজন মাফিক নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। এছাড়াও, বিজেতা ঔপনিবেশিকরা, তাদের উপনিবেশগুলোয় কর ও শোষণের হার পূর্বের তুলনায় বাড়িয়ে দেয়, যাতে মহাযুদ্ধের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। তবে, বিজেতাদের এ সকল পন্থা সফল না হয়ে উপরন্তু দুই যুদ্ধের অন্তরবর্তীকালের ইউরোপীয় ভূ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে। যার ফলাফলঃ ইউরোপ আরও দুটি বড় ধাক্কা বা সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। যথাঃ অর্থনৈতিক মহা মন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
১৯৩০-এর দশকে, ইউরোপীয় মহা মন্দা- বৈশ্বিক মহা মন্দায় (দ্যা গ্রেট ইকোনোমিক ডিপ্রেশন) রূপ নেয়। মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে চরমে পৌঁছে। এই মহা মন্দায়, ইউরোপীয়রা নিজেদের অর্থনীতি রক্ষায় আমদানি ও রপ্তানির উপর নানা শুল্ক ও করারোপ করে। তারা আন্তর্জাতিক বিনিময় হার (Exchange Rate) অনুসরণ না করে, নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের সুবিধা মাফিক মুদ্রামান নির্ধারণ করে। ফলে, তৎকালীন পারস্পারিক বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও মুদ্রামাণ বা বিনিময় হার নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এই সঙ্কটকে আরও তীব্র করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ব্যপক পরিবর্তন আনে। যুদ্ধচলাকালে, ইউরোপ ও আমেরিকার বিখ্যাত অর্থনীতিবিদেরা একমত হন যে, একটি গ্রহণযোগ্য ও কার্যকরি বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা-ই পারে মহামন্দার প্রভাবকে প্রশমিত করতে, এবং পারস্পারিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগের পথকে প্রশস্ত করতে। সে সম্মতির ভিত্তিতে, ১৯৪৮ সালে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শুল্ক নির্ধারণে তৎকালীন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো একটি সর্বসম্মত চুক্তি স্বাক্ষর করে, যাকে General Agreement on Tariffs and Trade (GATT) শিরোনামে অবহিত করা হয়। এই GATT আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভিত্তি হিসেবে প্রবর্তিত হয় এবং বিশ্ব বাণিজ্য গতি পায়।
GATT-এর সূচনাঃ
আটলান্টিক সনদ ও Land-Lease Agreement-কে ঘিরে GATT প্রতিষ্ঠার গল্পের দ্বিতীয় ধাপ আবর্তিত হয়। এই সনদ ও চুক্তিতে, পারস্পারিক উন্নতি ও আর্থিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি মুক্ত, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য বাণিজ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ফুটে ওঠে। চুক্তির লক্ষ্য বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেন যুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক বিনিময়, মুদ্রামাণ ও বাণিজ্য সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যপারে সম্মত হয়। যুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃগঠনের প্রয়োজনে, ১৯৪৪ সালে, ব্রেটন উডস সম্মেলনে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (International Monetary Fund- IMF), এবং বিশ্বব্যাংকের প্রধান অংশ IBRD (International Bank for Reconstruction and Development) প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে, একই সময়ে যাত্রার কথা থাকলেও, নানান জটিলতায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা (International Trade Organization- ITO) প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
তবে, উল্লেখযোগ্য ব্যপারটি হল, যুদ্ধ পরবর্তী ধ্বংস-প্রায় অর্থনীতিকে পুনঃ জীবিত করতে, বৃহৎ অর্থনৈতিক রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা (ITO) প্রতিষ্ঠা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়নি- উপরুন্তু তারা, ১৯৪৭ সালে, জেনেভায় একত্রিত হয়ে পারস্পারিক বাণিজ্য প্রসারে শুল্ক হার নির্ধারণে সম্মত হয়। বাণিজ্যের এই নির্দিষ্ট শুল্ক হার সংক্রান্ত আলোচনা বা নেগোশিয়েশন-ই একটি বহুপাক্ষিক শুল্ক ও বাণিজ্য চুক্তির (General Agreement on Tariff and Trade- GATT) সুচনা ঘটায় । ১৯৪৭ সালের ৩০ অক্টোবর, জেনেভায় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে GATT চুক্তি কার্যকর হয়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে, ২৩ টি দেশ GATT চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও, ১৯৬০ সাল নাগাদ প্রায় ৩৭টি দেশ GATT- চুক্তি স্বাক্ষর করে।
হাভানা সনদ, যার আদলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা (ITO) গঠিত হওয়ার কথা, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের অভাবে (যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে সনদটি পাশ না হওয়ায়) ITO প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ফলে, বিশ্বের বৃহৎ বাণিজ্যিক দেশগুলোর নিকট আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারে GATT একমাত্র গ্রহণযোগ্য বহুপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক চুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায় ও ব্যবহৃত হয়।
১৯৪৭ সালে, জেনেভা সম্মেলনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক হার নির্ধারণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা (নেগোশিয়েশন) হয়। এই সম্মেলনটি GATT প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি হলেও, GATT- এ শুল্ক হার নির্ধারণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। সে বিবেচনায় এই চুক্তির নাম "General Agreement of Tariff and Trade বা শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বহুপাক্ষিক চুক্তি"।
GATT চুক্তিটির বৈশিষ্ট্যঃ
GATT চুক্তিটি বিশ্লেষণ করলে GATT- এর চারটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। যথাঃ
১. GATT কোন সংগঠন/ সংস্থা/ অর্গানাইজেশন অথবা কোন বিচারিক প্রতিষ্ঠান/ আদালত নয়। বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনায় (পণ্য বা সেবায়) কতটুকু শুল্ক হার নির্ধারণ করা হবে তা নির্দিষ্ট করতে GATT স্বাক্ষরিত হয়।
২. GATT একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পর্ষদ (Decision Making Body তৈরি করবে। এই বোর্ড/ পর্ষদ প্রাথমিকভাবে দুটি কাজ করবে। যথাঃ
ক। আন্তর্জাতিক পণ্য বাণিজ্য সংক্রান্ত বিধি-বিধান তৈরি করবে, এবং
খ। মুক্ত বাণিজ্য প্রসারে নীতিমালা প্রণয়ন করবে।
৩. GATT একটি ফোরাম হিসেবে কাজ করবে যেখানে এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে একত্রিত হবে; বাণিজ্য সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ বা জটিলতা মোকাবিলায় চেষ্টা করবে; এবং পারস্পারিক বাণিজ্যের পরিমাণ কিভাবে আরও বাড়ানো যায় সে দিকটি গুরুত্ব দিবে। এবং
৪. GATT- এর প্রধান একটি কাজ কনসাল্টেশন বা আলোচনা সাপেক্ষে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত সংঘাত বা সংকট এবং মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাধাগুলোর (Trade Barriers) সমাধান দেওয়া। এছাড়াও, GATT- এর সদস্য দেশ কেউ চুক্তির বিধি অমান্য করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
GATT থেকে WTO: যাত্রাপথ
GATT থেকে WTO, এই যাত্রায় 'Round/ রাউন্ড' প্রত্যয়টি অধিক ব্যবহৃত হয়। বস্তুত, রাউন্ড বলতে GATT-এর সদস্যদের একটি নির্দিষ্ট সময়ে একত্রিত হওয়াকে বুঝায়। GATT-এর কাঠামো অনুযায়ী, সদস্য দেশের বাণিজ্য সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ বা নীতি-নির্ধারকেরা কয়েক সপ্তাহ বা মাস এমনকি বছরজুড়ে আলোচনা (নেগোশিয়েশন) চালিয়ে যাওয়াকে সংক্ষেপে রাউন্ড বলে। যেমন ধরুন উরুগুয়ে রাউন্ডের কথা যার ভিত্তিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (GATT এর উত্তরসূরী) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাউন্ডের সূচনা হয় ১৯৮৬ সালে উরুগুয়ে । তবে, বাণিজ্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনেই দীর্ঘ আট বছর ধরে উরুগুয়েতে GATT-এর এই নেগোশিয়েশন চলতে থাকে, এবং এই আলোচনার প্রেক্ষিতে ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার জন্ম হয়।
ঠিক এভাবেই, ১৯৪৭-৬১ সাল অব্দি GATT-এর পাঁচটি রাউন্ড পরিচালিত হয়। তবে এই রাউন্ডগুলোয় বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশগুলোর প্রভাব ছিলো অত্যাধিক। এই রাউন্ডগুলোয় রপ্তানি বাণিজ্য কিভাবে প্রসার ঘটানো যায় এবং পারস্পারিক পণ্য প্রবেশের অভ্যন্তরীন বাণিজ্য নীতিতে কিরূপ পরিবর্তন আনা জরুরি প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা হয়। এছাড়াও, এই বৃহৎ রপ্তানিকারকদের রাপ্তানি পণ্য যাতে সহজে অন্যদেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারে সে প্রয়োজনে আমদানি কর, শুল্ক ও আবগারি কর প্রভৃতি সংক্রান্ত আলোচনা হয়।
যেহেতু বৃহৎ রপ্তানিকারকরা ছিলো উন্নত রাষ্ট্র, তাই রপ্তানির মত তাদের আমদানির চাহিদাও ছিলো ব্যাপক। ফলে GATT-এর প্রথম পাঁচটি রাউন্ডে তারা পারস্পারিক বাণিজ্যের স্বার্থে যাবতীয় আমদানী কর বা শুল্ক বাতিলের ব্যপারে আলোচনা করেন। ঠিক একই সময়ে GATT-এর প্রথম পাঁচ রাউন্ডের ফলে ইউরোপের বৃহৎ অর্থনীতিগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারে শুল্ক বিহীন একটি অর্থনৈতিক/ বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু করেন। তবে এই পাঁচ রাউন্ডে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের আমদানি-রপ্তানি বা মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
এছাড়াও, GATT-এর পরবর্তী দুইটি রাউন্ডঃ কেনেডী রাউন্ড (৬ষ্ঠ), ১৯৬৪, এবং টোকিও রাউন্ড (৭ম), ১৯৭০, আমদানি শুল্ক কমানো বাদেও, বাণিজ্য প্রসারে যে বাধা বা চ্যালেঞ্জ (Non-tariff Barrier) মুখোমুখি হতে হয় সে বিষয় নিয়েও বিষদ আলোচনা হয়। এই আলোচনায় আমদানিকারকদের পছন্দের সুযোগ দেওয়া হয়। অর্থাৎ, পারস্পারিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিটি আমদানিকারক পণ্য বাছাইয়ের সুযোগ পাবে। যেমন ধরুন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন GATT-এর সদস্য হওয়ায় পারস্পারিক বাণিজ্য প্রসারে নিজেদের বাজারকে অন্যদেশের পণ্য আমদানির জন্য মুক্ত রাখবে- অর্থাৎ, GATT-এর মুক্ত বাণিজ্য নীতি অনুসরণ করবে। তবে, কেনেডী ও টোকিও রাউন্ড এই দেশগুলোকে পছন্দের সুযোগ দিবে তারা কোন কোন পণ্যে বাণিজ্য করবে, কোন কোন পণ্যে করবে না।
উরুগুয়ে রাউন্ডঃ WTO-এর ভিত্তি
১৯৮৬'র সেপ্টেম্বরে উরুগুয়ের পাস্তা দেল এস্তে GATT-এর অষ্টম নেগোশিয়েশন শুরু হয় যাকে সংক্ষেপে উরুগুয়ে রাউন্ড বলে। উরুগুয়ে রাউন্ডের শুরুতে ধারণা করা হয় এই আলোচনা রাউন্ড চার বছর পর্যন্ত চলবে। তবে, কিছু জটিলতা ও নির্দিষ্ট কিছু বিষয়, যেমনঃ কৃষি সংক্রান্ত ব্যপারে বৃহৎ অর্থনৈতিক জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য দেশের মাঝে দীর্ঘ নেগোশিয়েশন হয়। এই অচলাবস্থা দূরীকরণে, ১৯৯০'র প্রথমে, GATT-এর তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক আর্থার ডাংকেল GATT-এর সদস্যদের সামনে একটি বিস্তারিত খসড়া ডকুমেন্ট উপস্থাপন করেন। এই ড্রাফট বা খসড়া ডাংকেল ড্রাফট নামে পরিচিতি লাভ করে, এবং ১৯৯৩ সালের ১৫ ডিসেম্বরে ড্রাফটি অ্যাক্ট বা আইন হিসেবে গৃহীত হয়।
এই অ্যাক্টটিতে সর্বমোট ২৮টি এগ্রিমেন্ট বা চুক্তি ছিল। ১৯৪৭ সালে, GATT-এর যে মূল এগ্রিমেন্ট ছিলো, যেখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারে শুল্ক হার কমানোর বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিলো, উরুগুয়ে রাউন্ডের চুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দুটি নতুন ক্ষেত্রের অবতারনা ঘটায়। যথাঃ (ক) বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার (Intellectual Property Rights) এবং (খ) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্যের পাশাপাশি সেবাকেও (Service) সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।
অতএব, (১৯৪৭-৯৪) এই ৪৭ বছরে মোট আটটি আলোচনা/ নেগোশিয়েশন রাউন্ড WTO প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এই যাত্রায় প্রথম ছয়টি রাউন্ডের আলোচনা ছিল কিভাবে শুল্ক হার কমানোর মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্যের পথকে মসৃণ করা যায়। সপ্তম রাউন্ডের আলোচ্য সূচি ছিলো কিভাবে নন-ট্যারিফ বেরিয়ার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, এবং সর্বশেষ অষ্টম অর্থাৎ উরুগুয়ে রাউন্ডে নতুন দুটি বিষয়কে (মেধাস্বত্ত্ব ও সেবা) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অনুষঙ্গ করে।
|
রাউন্ড
|
সময়
|
প্রধান বিষয়বস্তু
|
স্বাক্ষরকারী
দেশ
|
|
০১
|
১৯৪৭
|
GATT-এর
চুক্তি স্বাক্ষর
|
২৩
|
|
০২
|
১৯৪৯
|
কিছু নির্দিষ্ট/ বিশেষ
পণ্যের শুল্ক হ্রাস
|
১৩
|
|
০৩
|
১৯৫০-৫১
|
কিছু
নির্দিষ্ট/ বিশেষ পণ্যের শুল্ক হ্রাস
|
৩৮
|
|
০৪
|
১৯৫৬
|
শুল্কের হার নতুনভাবে
নির্ধারণ
|
২৬
|
|
০৫
|
১৯৬০-৬১
|
ইউরোপীয়
কমিউনিটি বা ইউরোপীয় কাস্টম ইউনিয়নের জন্য ২০ শতাংশ শুল্ক হার হ্রাস
|
২৬
|
|
০৬
|
১৯৬৪-৬৭
|
প্রক্রিয়াজাত পণ্যের জন্য
নতুন করে শুল্ক হার নির্ধারণ
|
৬২
|
|
০৭
|
১৯৭৩-৭৯
|
নন-
ট্যারিফ/শুল্ক বাধা সংক্রান্ত চুক্তি
|
১০২
|
|
০৮
|
১৯৮৬-৯৩
|
কৃষি, সেবা, TRIPs,
TRIMs সংক্রান্ত চুক্তি
|
১২৩
|
|
০৯
|
২০০১
|
বাণিজ্য
ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি
|
১৪৪
|
Table 1: সংক্ষেপে GATT-এর রাউন্ডগুলো
WTO- প্রতিষ্ঠাঃ
আন্তর্জাতিক পণ্য ও সেবা সংক্রান্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিধিমালা প্রণয়ন ও পর্যবেক্ষণে একটি স্থায়ী আন্তঃরাষ্ট্রীয় (Inter-governmental Organization) পর্ষদ/ বডি হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আত্ম-প্রকাশ করেন। WTO-এর সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডের সম্মেলনের নগরী জেনেভায়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কিভাবে পরিচালিত হবে WTO সে রূপরেখা প্রদান করে। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে, WTO প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মরক্কোর মারকাশে GATT-এর সদস্যরা একত্রিত হয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ফলস্বরূপ, ১৯৯৫ সালের পহেলা জানুয়ারি, GATT-এর উত্তরসূরী হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) আত্ম-প্রকাশ করে। WTO-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলো ১২৮ টি রাষ্ট্র। ২০২১ সাল নাগাদ ১৬৪টি রাষ্ট্রকে WTO সদস্যপদ দেয়, এবং ২৫ টি দেশকে পর্যাবেক্ষকের মর্যাদা দান করে।
WTO কিভাবে কাজ করে?
সদস্য রাষ্ট্রের মন্ত্রীদের নিয়ে, WTO-এর সর্বচ্চো নীতি নির্ধারণী পর্ষদ (Policy Making Body) গঠিত হয়। প্রতি দুই বছর পরপর জেনেভায় এই মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। WTO-এর কার্যবিধি চালিয়ে নিতে এই নীতি নির্ধারনী/ মন্ত্রিপরিষদ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। WTO-এর অধীনে যে চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সেগুলোকেও পর্যবেক্ষণ করে।
WTO-এর যে সাধারণ পরিষদ/ General Council রয়েছে সেখানে WTO-এর সকল সদস্যই প্রতিনিধিত্ব করে। মন্ত্রিপরিষদ থেকে WTO-এর চুক্তির অধীনে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা সাধারণ পরিষদে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি পর্ষদ (Dispute Settlement Body) এবং বাণিজ্য নীতি পর্যালোচনা পর্ষদ (Trade Policy Review Body) হিসেবেও WTO-এর সাধারণ পরিষদ কাজ করে।
GATT ও WTO-এর কিছু মূলনীতিঃ
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক হার নির্ধারণ লক্ষ্যে GATT চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং WTO প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত আটটি রাউন্ডে এই শুল্ক হারের বিভিন্ন ধরণ নিয়ে বিষদভাবে, বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা বা নেগোশিয়েশন পরিচালিত হয়। তবে GATT ও তার উত্তরসূরি WTO, তাদের সনদ বা চুক্তিগুলোকে তিনটি মূলনীতির আদলে সাজিয়েছে। যথাঃ
১. Reciprocity:
'Reciprocity' শব্দের সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না। বাংলা অভিধানে 'Reciprocity'র অর্থ করা হয়েছে 'পারস্পারিক সুবিধাদানের নীতি', 'পারস্পারিক ক্রিয়াকালাপ', 'ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া' প্রভৃতি। তবে সংজ্ঞা অনুযায়ী, Reciprocity বলতে বুঝায় "পারস্পারিক মুনাফা/ সুবিধা বিবেচনায় কোন জিনিসের পারস্পারিক বিনিময়। বিশেষত, কোন রাষ্ট্র অন্য একটি রাষ্ট্রকে, কোন সংস্থা অন্য একটি সংস্থাকে যে সুবিধা প্রদান করে।" GATT-এর মৌলিক প্রিন্সিপাল/ নীতি হিসেবে Reciprocity বা পারস্পারিক সুবিধাদান নীতি বিভিন্ন পর্যায়ে বা রাউন্ডে GATT-এর চুক্তির অংশ হয়েছে।
প্রথমতঃ GATT-এর রাউন্ডগুলোতে যে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য সংক্রান্ত নেগোশিয়েশন বা আলোচনা হয়- সেগুলোর অধিকাংশই এই Reciprocal বা পারস্পারিক সুবিধা প্রদান লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলোচনা/ নেগোশিয়েশন রাউন্ডে দুইটি/ তিনটি/ একগুচ্ছো রাষ্ট্র পারস্পারিক আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য প্রসারে পারস্পারিক সুবিধাদান নীতি অনুসরণ করে।
দ্বিতীয়তঃ রাষ্ট্রগুলো যখন পারস্পারিক সুবিধা প্রদান শর্তে GATT- এর চুক্তির অধীনে স্বাক্ষর করে, তখন উভয়েই পারস্পারিক বাণিজ্যের নিমিত্তে নিজস্ব বাজার ব্যবস্থাকে সুবিধা প্রদানকারী দেশের জন্য উন্মুক্ত করবে। এক্ষেত্রে, তারা যদি নিজেদের মধ্যকার সুবিধা নীতি থেকে সরে আসতে চায়, উভয়কে পুনরায় GATT-এর অধীনে আলোচনায় বসতে হবে।
যদি উদাহরণ দিয়ে বলি, বাংলাদেশ ও ভারত যখন GATT/ WTO চুক্তি স্বাক্ষর করে, তখন উভয়ই এই শর্তে চুক্তি স্বাক্ষর করে যে বাংলাদেশ চাইলেই ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশ করাতে পারবে, ভারতের ক্ষেত্রেও একই হবে। GATT/ WTO চুক্তির সদস্যগুলো এই পারস্পরিক সুবিধা বিনিময় শর্তেকে মেনে নিয়েই এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার অংশ হয়েছে।
২. Most-Favored Nation Treatment (MFN):
GATT-এর দ্বিতীয় মৌলিক প্রিন্সিপাল বা নীতি MFN সেবা/ সুযোগ। GATT-এর যেকোনো নেগোশিয়েশন বা রি-নেগোশিয়েশনের বেলায় MFN নীতি অনুসরণ আবশ্যক। MFN সেবায়, কোন আমদানিকারক আমদানির প্রয়োজনে কোন রপ্তানিকারকের রপ্তানিতে বৈষাম্য করবে না। অর্থাৎ, যখন GATT-ভুক্ত একটি রপ্তানিকারণ রাষ্ট্রকে কোন একটি রাষ্ট্র নির্ধারিত শুল্কে নিজের বাজারে প্রবেশের সুবিধা দিবে, তখন স্বাভাবিকভাবে, GATT-এর অন্যান্য সদস্যগুলোও, আমদানিকারক ঐ রাষ্ট্রের বাজারে একই শুল্কহারে পণ্য রপ্তানির সুযোগ পাবে। যেমন ধরুন যুক্তরাষ্ট্রের কথা। যুক্তরাষ্ট্র কোন নির্দিষ্ট একটি হারে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের বাণিজ্যের সুবিধা দেয়। ফলে, যুক্তরাষ্ট্র GATT ও WTO এর সদস্য হওয়ায়, এই চুক্তি দুটির MFN সেবা প্রিন্সিপাল/ নীতি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মত অন্যান্য দেশের বাণিজ্যের স্বার্থেও নিজের বাজারকে উন্মুক্ত রাখতে হবে, এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোনরূপ বৈষম্য করতে পারবে না।
উল্লেখ্য, GATT-এর সদস্যপদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে MFN সেবা একটি বড় কারণ। এমনকি, এমনও অনেক রাষ্ট্র রয়েছে যারা GATT-এর সকল চুক্তির অংশ নয়, তথাপি GATT-এর সকল সদস্যের পারস্পরিক আমদানি ও রপ্তানি প্রসারে MFN সেবা ভোগ করতে পারে। ফলে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো যারা নিজেদের অর্থনৈতিক স্থায়ীত্বের জন্য জন্য রপ্তানির উপর নির্ভরশীল, তারা ধারাবাহিকভাবে GATT-এর অংশ হয়েছে।
MFN সেবার একই গুরুত্ব WTO তেও রয়েছে। বিশেষত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে MFN-কে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। তবে, GATT/ WTO উভয়েই আঞ্চলিক পর্যায়ে পারস্পরিক বাণিজ্য প্রসারে Preferential Trade Agreements (PTAs) চুক্তি স্বাক্ষরের অনুমোদন দেয়। তবে, এক্ষেত্রে PTAs, MFN-এর চেয়েও কম হারে শুল্ক নির্ধারণের সুযোগ লাভ করে, যেটি শুধু এই PTAs ভুক্ত দেশগুলোই ভোগ করবে। ফলে, বর্তমান সময়ে, আঞ্চলিক পর্যায়ে PTAs এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ও পাচ্ছে। যেমন: ASEAN, RCEP, SAPTA, EU, AFTA.
এছাড়াও, অনুন্নত দেশের বাণিজ্য প্রসারে, PTAs এর মত Generalized System of Preference (GSP) সুবিধার কথাও WTO/GATT এ উল্লেখিত হয়েছে। যেখানেও MFN-এর চেয়ে কম শুল্ক হারে বাণিজ্য পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যদিও PTAs বা GSP-কে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যে GATT ও WTO অনুমোদন দিয়েছে, তবে, MFN সেবা GATT ও WTO-এর সকল সদস্যই ভোগ করবে- হতে পারে সে PTAs/ GSP ভুক্ত।
৩. National Treatment:
GATT/ WTO- চুক্তিতে National Treatment মৌলিক নীতির মূল কথাটি খুব সহজ- অর্থাৎ, কোন বিদেশি রাষ্ট্র/ কোম্পানি (ধরুক: রাষ্ট্র ক) প্রভৃতির পণ্য যখন GATT/ WTO-এর সদস্য দেশের (ধরুন: রাষ্ট্র খ) বাজারে প্রবেশ করবে তখন শুল্ক/ মাসুল সে রাষ্ট্রটি (রাষ্ট্র ক) শুধু একবারই দিবে। অর্থাৎ, আমদানিকারক দেশের (রাষ্ট্র খ) উৎপাদিত পণ্য যত সহজে অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পায়, রপ্তানিকারকের (রাষ্ট্র ক) উৎপাদিত পণ্যও অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশের সমান সুযোগ পাবে- এক্ষেত্রে (রাষ্ট্র ক) কোন অতিরিক্ত কর/ শুল্ক ইত্যাদি দিবে না। বিদেশী পণ্যকে কোন ধরণের অতিরিক্ত/ শুল্কের মাধ্যমে দেশীয় পণ্যের সাথে বৈষাম্য করা যাবে না।
অর্থাৎ, দেশীয় পণ্য দেশের বাজারে যে সুবিধা পায় বিদেশি পণ্যটিও সেই সুযোগ পাবে। বিদেশি পণ্যের বিপরীতে দেশীয় পণ্যের স্থান ধরে রাখতে কোন রাষ্ট্রীয় ভর্তুকী ব্যবস্থা চলবে না। যেমনঃ বাংলাদেশের পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একটা দেশীয় পণ্য যে সুবিধা পায় তেমনটাই পাবে, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে তাকে একবারই যুক্তরাষ্ট্রের নির্ধারিত শুল্ক প্রদান করতে হবে, অন্য কোন বাড়তি মাসুল বাংলাদেশকে দিতে হবে না।
GATT/ WTO কে তার এই মূলনীতি সম্পর্কিত বেশী বিরোধ/ সংকট সমাধান করতে হয়। অনেক সদস্য রাষ্ট্রই National Treatment এই মূলনীতিকে অমান্য করে। যেমনঃ চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ।
WTO ও GATT-এর মধ্যে পার্থক্য
|
GATT
|
WTO
|
|
GATT ছিলো একটি অনানুষ্ঠানিক (Ad-Hoc)
এবং অস্থায়ী পরিচালনা পর্ষদ
|
WTO একটি আন্তরাষ্ট্রীয় বৈধ ও আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের চুক্তিকে
WTO এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো অনুমোদন (Ratify) দিয়েছে।
|
|
GATT ছিলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনায়
কিছু বিধিবদ্ধ নীতিমালা যা বহুপাক্ষিক কয়েকটি এগ্রিমেন্টের আদলে গড়ে ওঠে। এখানে
চুক্তির সদস্যদের চুক্তির আইনকে মেনে চলবে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা (Binding) নাই।
|
যে সকল
চুক্তির আদলে WTO তৈরি হয়েছে তার প্রতিটিই স্থায়ী ও সদস্য কর্তৃক অনুমোদিত। তাই আন্তর্জাতিক
বাণিজ্য পরিচালনায় WTO-এর নীতিমালা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আছে।
|
|
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত GATT-এর
যে বিরোধ- মীমাংসা পদ্ধতি আছে তা খুবই ধীরগতির, এবং তাতে বাধ্যবাধকতা (Binding) নাই।
|
WTO-এর বিরোধ মীমাংসা পদ্ধতি খুব দ্রুত এবং আইনবদ্ধ। একটা কথা
প্রচলিত- GATT যেক্ষেত্রে দন্তহীন, WTO সেক্ষেত্রে দন্তওয়ালা শিকারী।
|
|
GATT- এমন একটি ফোরাম ছিলো, যেখানে
চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী পক্ষ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত সমাধান ও বাণিজ্য
সংক্রান্ত বিবিধ বিষয়ে আলোচনার নিমিত্তে উপস্থিত হত।
|
অন্যদিকে,
WTO একটি পূর্ণ আইনি সংগঠন যেখানে নির্দিষ্ট সময় করে WTO-এর চুক্তিগুলো নিয়ে সিদ্বান্ত
নেওয়া হয়। বছরে অন্তত দুইবার WTO-এর সদস্যরা একত্রিত হয় যাকে মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলন
বলা হয়।
|
|
GATT- এ শুধু পণ্য কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক
বাণিজ্যে শুল্কের হার কমানো/ নির্ধারণ করা হয়।
|
WTO- তে পণ্যের পাশাপাশি সেবা, বুদ্ধিবৃত্তি অধিকার, কৃষি এবং
পোষাক শিল্প প্রভৃতিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান নিয়ামক হিসেবেব স্বীকৃতি দেওয়া
হয়।
|
Table 2: GATT ও WTO এর মধ্যকার পার্থক্য
WTO- অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রকে কী সুবিধা দেয়?
বিশ্বের দারিদ্র পিড়িত দেশগুলোর (অনুন্নত ও উন্নয়নশীল) জন্য WTO চুক্তিতে কিছু বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। যেমনঃ
১. অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে WTO যে সকল চুক্তি/ এগ্রিমেন্ট করা হয়, সেগুলো পূরণে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ, উন্নত দেশের তুলনায় অধিক সময় পায়। অর্থাৎ, উরুগুয়ে রাউন্ডে Agreement Measures of Support (AMS) নামে WTO তে একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়, যেখানে সদস্যদের অভ্যন্তরীন বাজারে ভর্তুকির হার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে শূণ্যে আনার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে, উন্নত দেশের ক্ষেত্রে যেখানে প্রায় ২০ শতাংশ হারে অভ্যন্তরীন প্রণোদনা হ্রাসের কথা বলা হলেও, উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে সেই হার মাত্র ১৩.৩ শতাংশ।
এই অনুচ্ছেদ অনুন্নত দেশের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, অন্তত একটা লম্বা সময় অনুন্নত দেশকে দেওয়া হয় নিজেদের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য। যেমনঃ বাংলাদেশও এই সুযোগ ভোগ করতো, কিন্তু ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে বেধে দেওয়া সময় শেষ হবে, তখন নতুনভাবে বাংলাদেশকে তার অভ্যন্তরীন উন্নয়নের দিকে, বিশেষত বাজার ব্যবস্থাকে নতুনভাবে অর্থাৎ WTO এর আদলে সাজাতে হবে।
২. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের মাধ্যমে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন বাজারে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশকে অধিকমাত্রায় প্রবেশের সুযোগ দেওয়া যায়। সমরাস্ত্র ব্যতিরেকে পূর্বে কিছু পণ্যের পারস্পারিক বাণিজ্য সীমিত ছিলো, বিশেষত সেই পণ্য বাণিজ্যে এক রাষ্ট্র অপরকে তার অভ্যন্তরীন বাজারে প্রবেশের সামান্য সুযোগ দিত। উরুগুয়ে রাউন্ডে এই সীমানা প্রাচীর ভাঙা হয়। সেক্ষেত্রে, একটি নির্দিষ্ট শুল্ক হারে সেই পণ্যগুলোকে পারস্পারিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়।
৩. বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এমন কোন নীতিমালা গ্রহণ করবে না যা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশকে নিজের স্বার্থ বিরোধী হয়, এবং তাদের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাকে কোণঠাসা করে ফেলে। এক্ষেত্রে WTO অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের কৃষিখাতকে সংরক্ষণে বাধা দিবে না। যেমন: WTO এর কৃষি সংক্রান্ত চুক্তিতে বলা হয়েছে প্রতি ছয় বছর পরপর উন্নত দেশ প্রায় ৩৬ শতাংশ কৃষি পণ্য আমদানি শুল্ক কমাবে, উন্নয়নশীল দেশ সেক্ষেত্রে ২৪ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমাবে, কিন্তু অনুন্নত দেশের ক্ষেত্রে কোন শুল্ক কমানোর বাধ্যবাধকতা এই চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ অনুন্নত রাষ্ট্রকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
৪. বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)- এর চুক্তিতে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এই সহযোগিতার লক্ষ্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা। ২০০১ সালের দোহা সম্মেলনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফান্ড গঠন করা হয়। প্রায় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সেই ফান্ডে জমা রাখা হয়। এই ফান্ডের অধীনে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও সার্বিক সক্ষমতা উৎকর্ষের দিকে জোর দেওয়া হয়।
WTO- কেন এত হৈচৈ (সমালোচনা) কেন?
WTO-প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিলো আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করা যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের সাহায্য করবে, এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই প্রসার WTO-এর সদস্য দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। তবে, যাত্রার সূচনা থেকেই অর্থনীতিবিদিদের কাছে, বিশেষত রাজনীতির অর্থনীতিবিদদের (Political Economist) কাছে WTO প্রশ্নবিদ্ধ ও সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু কেন WTO সমালোচিত হচ্ছে, তার কয়েকটি কারণ নিচে উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমনঃ
১. WTO- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উন্মোক্ত/ অবাধ বাণিজ্যে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই অবাধ বাণিজ্য, বস্তুত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় উন্নত পুঁজিবাদী দেশকে অধিক মুনাফা অর্জনে সহায়তা করে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বাজারে উন্নত দেশের অবাধে প্রবেশ তাদের (অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ) স্থানীয় শিল্প-কারখানার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, মুক্তবাজার অর্থনীতি বা বাণিজ্য ব্যবস্থা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশকে স্বল্প বা বিনা শুল্কে বিদেশি পণ্য তাদের বাজারে প্রবেশের সুযোগ দিতে বাধ্য করে, পাশাপাশি দেশিয় পণ্য বিকাশে সরকারি প্রণোদনাকে বাধা দেয়। তবে, রাজনীতির অর্থনীতিবিদদের (Political Economy) ভাষায়, আজ যারা উন্নত রাষ্ট্র, তাদের ইতিহাসও কিন্তু ভিন্ন। উন্নত হওয়ার পূর্বে তারাও নিজেদের বাজারকে বিদেশি পণ্য থেকে রক্ষায় কড়া শুল্ক আরোপ করত।
২. WTO- এর একটি মৌলিক নীতি Most Favored Nation (MFN) সেবা বজায় রাখা, অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সকলের জন্য সমান শুল্কে অভ্যন্তরীন বাজারে প্রবেশ অধিকার বজায় রাখা- সেখানে কোনরূপ বৈষম্য না করা। কিন্তু, MFN সেবা নীতির বাস্তবায়ন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে বিতর্ক তৈরি করে। কারণ, এই নীতিকে মেনে নিলে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র তাদের বাজার ও স্থানীয় শিল্পকে বিদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে পারবে না। বিদেশি পণ্য প্রবেশ তাদের স্থানীয় বাজারকে অস্থির করে তুলবে, এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে কোনঠাসা করে ফেলবে। তাই MFN সেবা নীতি যদিও বৈষম্যহীন প্রেক্ষাপট তৈরির কথা বলে, তবে তা, রাজনীতি অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষিতে প্রযোজ্য নয়।
৩. WTO-কে সমালোচনার আরও একটি বড় কারণ WTO কৃষিপণ্যের উপর শুল্ক হার বাড়ানোর কথা বলে, কিন্তু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কৃষিতে ভর্তুকি কমানোর জন্য চাপ দেয়। কিন্তু উন্নত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নীতিটি সহজ ও গ্রহণযোগ্য হলেও, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল কৃষি নির্ভর অর্থনীতির জন্য নীতিটি খুবই নেতিবাচক। কৃষি পণ্যের উপর অধিক হারে শুল্ক আরোপ করায় বিভিন্ন কৃষিপণ্য ও কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেকে বাধা পেতে হয়। তবে সবচেয়ে এলার্মিং হল WTO উন্নয়নশীল দেশকে নিজের কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানোর জন্য চাপ দেয়, যা উন্নয়নশীল দেশের জন্য আত্মঘাতী।
৪. এছাড়াও, WTO- উন্নয়নশীল দেশকে তার উৎপাদন খাত পরিবর্তন করতে চাপ দেয়। যেমন: WTO- উন্নয়নশীল দেশকে কৃষিখাতকে শিল্পখাতে রূপান্তরের জন্য চাপ দেয়। কারণ, উন্নত দেশের চাহিদা মেটাতে শ্রমিক পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ যদি তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন করতে পারে, তবে স্বল্প মেয়াদে উন্নত দেশের অধিক মুনাফা অর্জন হয়, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের সক্ষমতা হ্রাস পায়। যেমন: বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে প্রচুর বাংলাদেশি যুক্ত হচ্ছে যাদের অধিকাংশই কৃষির সাথে জড়িত ছিলো।
৫. এছাড়াও, মানব সৃষ্ট প্রাকৃতিক দূষণের অন্যতম কারণ উন্নত বিশ্বের ডিজাইন করা শিল্প-কারখানা ভিত্তিক সমাজ কাঠামো। WTO- শিল্পায়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়, কিন্তু এই শিল্প-কারখানায় উৎপাদন পরিবেশের জন্য কতটা মারাত্মক হতে পারে বা বর্তমানে হচ্ছে তা বিবেচনা করে না। জলবায়ু পরিবর্তন- উন্নত বিশ্বের উৎপাদন ব্যবস্থা ও ভোগবাদী জীবনের ফসল। এই পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্ব খুব খারাপভাবে ভোগ করছে। বাংলাদেশের মত সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ শিকার।
উপসংহার:
GATT থেকে WTO-এর বিবর্তন যাত্রা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ/ প্রধান ভূমিকা রেখেছে। পশ্চিমা উন্নত দেশের পারস্পারিক সংঘাত প্রশমনে বাণিজ্য সবচেয়ে কার্যকারি অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, এবং তার ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। তবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্রমেই পুঁজিবাদকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি বা আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়ে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনুচ্ছেদ ও মূলনীতি সেভাবেই সাজানো।
কিন্তু এই মূলনীতি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কেন্দ্রের উন্নত দেশকে যতটা সুবিধা বা মুনাফা পায়, এই ব্যবস্থার প্রান্তে নিবিষ্ট অনুন্নত ও উন্নয়নশীল ততটা সুবিধা আদায় করতে পারছে না, আবার WTO প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য ব্যবস্থার বিপরীতেও যেতে পারছে না। চীন, রাশিয়া, ভারতের মত বৃহৎ উন্নয়নশীল দেশ যারা ক্রমেই উন্নতি করছে, তারা এই ব্যবস্থার বৈষাম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, এবং ব্রিকসের মত প্লাটফর্মকে WTO-এর বিপরীতে দাড় করানোর প্রচেষ্টায় আছে। তবে সমালোচনা থাকলেও, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুল্ক হ্রাস/ নির্ধারণে GATT ও WTO- এর তৈরি বিধিমালা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারে কার্যকরি ভূমিকা পালন করছে বলে অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন।
লেখকঃ
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
যে বইগুলোর সাহায্য নেওয়া হয়েছেঃ
- INTERNATIONAL RELATIONS: The Key Concepts (By- Martin Griffiths, Terry O'Callaghan and Steven C. Roach)
- Key Concepts in International Relations (By- Thomas Diez, Ingvild Bode, Aleksandra Fernandes da Costa)
- International Relations: The Key Concepts (By- Steven C. Roach, Alexander D. Barder)
- International Encyclopedia of Political Science (By- Badie, Bertrand)
- From the GATT to the WTO: A Brief Overview. https://guides.ll.georgetown.edu/c.php?g=363556&p=4108235#:~:text=The%20Uruguay%20Round%2C%20conducted%20from,for%20implementing%20and%20extending%20them.
No comments