Header Ads

Header ADS

ব্রেটন উডস সম্মেলন (Bretton Woods Conference): সোনার মূল্যে ডলার নাকি ডলারের মূল্যে সোনা

 

 ব্রেটন উডস সম্মেলন (Bretton Woods Conference): 
সোনার মূল্যে ডলার নাকি ডলারের মূল্যে সোনা


সূচনাঃ

আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা অনেকগুলো স্তর/ ধাপ পেরিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে; প্রতিটি ধাপ পার হতে কোন না কোন ধাক্কার (যেমনঃ যুদ্ধ,অর্থনৈতিক মন্দা, রোগ-ব্যাধি, মহামারি ইত্যাদি) প্রয়োজন পরেছে; এবং এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় শক্তি বা হেজমনের উত্থান-পতন ঘটেছে। আলোচনার টপিক অনুযায়ী আমরা ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থা, বিশেষত অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল কিভাবে চলবে তা নিরুপনে ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডসে যে কনফারেন্সটি হয়েছিলো সে সম্বন্ধে জানবো।  

ঐতিহাসিকদের ভাষায়, ১৯৪২ সালে অক্ষ শক্তি (জার্মানি, জাপান এবং ইতালি), সমন্বিতভাবে ফ্যাসিবাদ ও সম্প্রসারণনীতিকে সামনে রেখে ২য় মহাযুদ্ধের সুচনা ঘটান, যদিও এর পূর্বে চেকোস্লোভাকিয়ায় আক্রমণের মাধ্যমে জার্মানি ইউরোপিয়ান যুদ্ধের সুত্রপাত করে।

উল্লেখ্য, শক্তির পরিবর্তন প্রক্রিয়ার জন্য যে ধাক্কার দরকার ছিল, ২য় বিশ্বযুদ্ধ সেক্ষেত্রে ছিল অগ্রগামী- অর্থাৎ, এই মহা যুদ্ধের পর এক নতুন পৃথিবী গোছানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। মজার বিষয় হল, তখনকার অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনা-অর্থাৎ, এই মহাযুদ্ধ চলাকালে, বিশেষত আটলান্টিক সনদে, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেমন হবে তার একটি রূপরেখা তৈরি করে।

তৎকালীন যারা নীতি নির্ধারকদের ভাষায় দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালীন সময়ে (Interwar Period) মহামন্দা ও ফ্যাসিবাদের উত্থানই তখনকার রাষ্ট্রগুলোকে বৈষম্যমূলক বাণিজ্য ও মুদ্রানীতি তৈরি করতে বাধ্য করে বা প্ররোচিত করে। অর্থাৎ এই সময়ে রাষ্ট্রগুলো তাদের দিশেহারা অর্থনীতিকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক মানদন্ডকে ইচ্ছেমত পরিবর্তন করে।


ব্রেটন ঊডস সম্মেলনঃ ঐতিহাসিক যাত্রা

১৯৪১ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি থিওডোর রুজবেলট ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখে কৌশলে এগোতে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামরিক শক্তির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে একটি মুক্ত অর্থনৈতিক/বাজার কাঠামো তৈরির ব্যাপারে বেশি জোর দেওয়া হয়। ১৯৪১ সালে রুজভেল্ট যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের সাথে আটলান্টিক সনদ স্বাক্ষর করেন। অনেকেই এই সনদকে জাতিসংঘের স্থাপনের প্রথম পদক্ষেপ বললেও, এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেমন হবে তার সুরাহা করা।    

আপনি যদি আটলান্টিক সনদটি পড়েন, আপনি সনদের ৪র্থ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট দেখতে পাবেন সনদে লেখা আছে,

“All countries should have access, on equal terms, to the trade and to the raw materials of the world which are needed for their economic prosperity.”-

অর্থাৎ, অর্থনৈতিক উন্নতির প্রয়োজনে সকল রাষ্ট্রই বানিজ্য ও প্রয়োজনয়ীয় কাঁচামালের সমতা অর্জনের অধিকার পাবে। এই আটলান্টিক সনদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মধ্যকার জমি ধার নেয়া বিষয়ক চুক্তি সাক্ষরিত হয় (Land-Lease Agreement)।

এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, যুদ্ধের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সরঞ্জাম এবং অক্ষ শক্তির বিপক্ষে যুদ্ধরত প্রতিটি রাষ্ট্রকে যুদ্ধের কাঁচামাল সহজে ধার দিতে সমর্থন প্রদান করেন। বিশেষত ব্রিটেনের পক্ষে এই চুক্তিটি খুবই প্রয়োজনীয় ছিল যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নিজেদের গুরুত্বটা ধরে রাখতে, যদিও সেক্ষেত্রে ব্রিটেন সফল হয়নি। 

যাহোক, এই আটলান্টিক সনদকে বাস্তবে রূপায়িত করার প্রচেষ্টা শুরু হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধের একদম শেষের দিকে। ১৯৪৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন সহ আরো ৪২ টি নতুন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পাশায়ারের ছোট্ট শহর ব্রেটন উডসে একটি সম্মেলন আয়োজন করেন যা ইতিহাসে ব্রেটন উডস সম্মেলন নামে পরিচিত। এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক অর্থনীতিকে সুচারু করতে কিছু নীতিমালা সম্বলিত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ হবে আন্তঃরাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বানিজ্য ও মুদ্রাব্যবস্থার একটা সমন্বয় তৈরী করা। এই সম্মেলন আয়োজনের পিছনে মূল নির্দেশক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হেরী হোয়াইট ও ব্রিটেনের পক্ষ থেকে জন মেয়ানার্ড কেইন্স। 


ব্রেটন উডস সম্মেলনকে অনেকে আবার International Monetary and Financial Conference হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। এই সম্মেলনে উল্লেখিত প্রস্তাবগুলো ছিলো খুবই ব্যবহারিক ও সময় উপযোগী। এই সম্মেলনের আয়োজনের উদ্দেশ্য শুধু ইউরোপের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার ছিলনা-বরং ইউরোপের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বানিজ্যিক কার্যের জন্য একটি কার্যকারি রূপরেখা গঠন করার প্রয়োজনেই সম্মেলনটি আয়োজিত হয়েছিল, এবং বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনেকাংশেই এই সম্মেলনের ফলাফলকে বহন করে যাচ্ছে।

এদিকে যদিও উক্ত সম্মেলনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা যোগ দেয় তবে তারা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। যেহেতু এই সম্মেলনে যে বানিজ্য ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণই পুজিবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে যাচ্ছে তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন আদর্শিক কারণেই চুক্তির অংশীদার হওয়া থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখে। 

উল্লেখ্য, এই সম্মেলনের মূল নকশা তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রেরই করা। যখন মহামন্দা ইউরোপকে একদম দমিয়ে দিয়েছিল- তখন, ১৯৩০ এর দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প-কারখানার উৎপাদন প্রায় দিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল; বেকারত্ব প্রায় হ্রাস পেয়েছিল, এবং ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অক্ষ শক্তির (জার্মানি, জাপান ও ইতালি) বিপক্ষে সবচেয়ে বড় আঘাতকারী ছিলো যুক্তরাষ্ট্র।


ব্রেটন উডস সম্মেলন ও বিশ্ব অর্থনীতিঃ

এছাড়াও ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় সমগ্র পশ্চিম ইউরোপ জুরে আমেরিকান সৈন্য অবস্থান করছিল, এদবং ইউরোপীয়ানরা বুঝেছিল, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই চালিত করতে পারে। এভাবেই ব্রেটন ঊডস সম্মেলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নকশাকৃত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি হতে থাকে, যেমনঃ বিশ্বব্যাংক।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক রাজনীতির অর্থনীতির (International Political Economy) ভাষায়, ইউরোপের পর্যদুস্তু অবস্থার সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রেটন উডস সম্মেলনে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ হ্যারী হোয়াইটের প্রস্তাবনাকেই গ্রহণ করেন, বিপরীতে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ মেইনার্ড কেইন্সের Central World Currency Reserve ধারণাটিকে প্রত্যাক্ষান করেন।

কেইন্স এমন একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার ধারণা দেন, যে পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বানিজ্যের বার্ষিক যে উদ্বৃত্ত হবে, তা কেন্দ্রীয়ভাবে বাণিজ্যে ঘাটতিপূর্ণ বা অনুন্নত দেশের মাঝে পুনঃবন্টনের সুযোগ থাকবে।

মেইনার্ড কেইন্সের ধারণার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র হ্যারী হোয়াইটের দুটি বিষয়কে সম্মেলনে গুরুত্ব দেন। যথাঃ

  1. মুক্তবাঁজার অর্থনীতি ব্যবস্থা তৈরি করা, এবং

  2. সহজেই পুঁজির স্থানান্তর- অর্থাৎ একটি বর্ডার বিহীন বাঁজার তৈরি করা।


যাহোক, ব্রেটন উডস সম্মেলনের ফলাফল হিসেবে যে নীতি গ্রহণ করা হয় তার উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখা, এবং বানিজ্য সম্প্রসারনে সহায়তা করা। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সম্মেলনে তিনটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের জন্ম লাভ করে। যথাঃ

  1. International Bank for Reconstruction and Development (IBRD)

  2. International Monetary Fund (IMF)

  3. General Agreement on Trade and Tariffs (GATT)



বিশ্বব্যাংক প্রাথমিক পর্যায়ে তৈরি করা হয়েছিল যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউরোপকে পুনঃগঠনের অভিপ্রায়ে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল(IMF) তৈরি করা হইছিলো ট্রান-আটলান্টিক- অর্থাৎ আটলান্টিকের দুই পাশের উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বানিজ্যের ক্ষেত্রে একটী ফিক্সড বিনিময় রেট তৈরি করা, এবং GATT তৈরির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্যপূর্ণ বানিজ্য ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে একটি সমতা ভিত্তিক বানিজ্য ব্যবস্থা প্রনয়ণ।

পূর্বতন সকল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে ব্রেটন উডসকে পৃথক করেছিল একটি নিরাপদ Fixed Exchange Rate এবং কার্যকারি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও নীতি মালা। নীতিমালা অনুযায়ী ডলার ও স্বর্ণের উপর ভিত্তি করেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) মুদ্রার মান নির্ধারন করবেন। 

যাহোক, যদিও যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক অবস্থাকে পুনরুদ্ধারে ব্রেটোন উডস খুব সফল একটি সম্মেলন ছিল- কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে এই সিস্টেমে অনেক জটিলতা দেখা যায়। ডলারকে স্বর্ণের রূপান্তরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যেতে স্বল্প কালে সক্ষম হয়। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র তার বৈদেশিক সহায়তা দিত ডলারের হিসেবে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের ক্ষেত্রেও ডলারের বিনিময়ে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতো- আবার সেই ডলারের মূল্যেই সোনার দাম নির্ধারিত হত।

১৯৭০ এর পর যুক্তরাষ্ট্রের সোনার যে মজুদ ছিলো তা হুট করেই কমতে শুরু করে, ২৫ বিলিয়ন ডলার থেকে মাত্র ১০ বিলিয়নে ডলারে নেমে আসে। ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে সোনার সংকট তৈরি হয়। উপায় না পেয়ে, ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকে সোনার সাথে বিনিময়ের রীতি থেকে সরে আসেন। ফলে আবারো সেই মহামন্দার মত পরিস্থিতি শুরু হয়। 


উপসংহারঃ

যদিও ব্রেটন উডস সিস্টেমের পতন হয়েছে ১৯৭০ এর পরেই- কিন্তু এই সম্মেলনের ফলে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। সিস্টেমের পতন হলেও, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনীয়তা বিশ্ব অনুধাবন করে- পাশাপাশি, ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিশ্বায়নের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তাকে বজায় রাখার জন্য অবশ্যই একটি নতুন ব্যবস্থার প্রয়োজন পরে। যার প্রেক্ষিতেই, পরবর্তীতে, উরুগুয়ে রাউন্ডের মাধ্যমে বিশ্ব বানিজ্য সংস্থা (WTO) প্রতিষ্ঠিত হয়।




ভাবানুবাদকঃ 
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়  

 

মূল বই: 
International Relations: The Key Concepts 
By- Martin Griffith, Tarry O'Callagahan & Steven C. Roach




No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.