World System Theory: কে বাহির, কে ভিতর?
![]() |
World System Theory |
World System Theory: কে বাহির, কে ভিতর?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থীদের এই পাঠ্যক্রম অধ্যায়নকালে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে নানা ধারনা (Assumptions) ও দৃষ্টিভঙ্গি (Perspective) তৈরি হয়। নানা ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থীরা এটা বুঝতে পারেন, যে বিশ্ব ব্যবস্থা নিয়ে তারা অধ্যায়ন করছেন- তার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল সে বিশ্ব ব্যবস্থা বিভাজিত। অর্থাৎ, বিশ্ব ব্যবস্থা অনেকগুলো ভাগে বিভক্ত।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যায়নের সূচনা-ই হয়েছিলো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় সকল রাষ্ট্রের সহবস্থান নিশ্চিত করা ও কিভাবে বিশ্বকে আরও একত্র ও শান্তিপূর্ণ করা যায় সে উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতি, মতাদর্শ প্রভৃতি কারণে বিশ্ব ব্যবস্থায় বিভক্তি দেখা দেয়।
World System Theory-এর প্রবক্তারাও এই বিভক্তিকে স্বীকার করেন- তবে তাদের ভাষায় বিশ্ব ব্যবস্থাকে পূর্ণরূপে বুঝতে গেলে বিশ্ব ব্যবস্থাকে একটা একক বা ইউনিট বা সিস্টেম ধরেই আলোচনা করতে হবে। বিশ্ব ব্যবস্থা তত্ত্বের তাত্ত্বিকরা বলেন- রাজনৈতিক, অর্থনীতি, সাংস্কৃতি বা মতাদর্শের ভিত্তিতে যে সামাজিক বা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে- তা বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রের বদলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ভিত্তি বা লেভেল (Level of Analysis) ধরে আলোচনা করতে হবে।
অনেক অর্থনীতিবিদ "বিশ্ব ব্যবস্থা" কে পুঁজিবাদী বিশ্ব নামেও অভিহিত করেন। এই ধারটি এসেছে জার্মান প্রত্যয় 'Weltwirtschaft" থেকে । Weltwirtschaft দ্বারা এমন একটি আর্থিক ব্যবস্থা বুঝায় যেখানে একধরনের বিভাজন বিদ্যমান থাকে।
বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্বটি যদিও ১৯৫০-এর দশকের নির্ভরশীল তত্ত্ব ও ফরাসী এনালস স্কুল অব হিস্ট্রোরিওগ্রাফি থেকে অনুপ্রেরণা পায়, তবে ইমানুয়েল ওয়ালেরস্টেইনকে (Immanuel Wallerstein) সমসাময়িক World System তত্ত্বের প্রণেতা/ প্রবক্তা বলা হয়। ওয়ালেরস্টেইন বলেন, আধুনিক পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার সূচনা হয় ১৪৫০ থেকে ১৬৭০ সালের মাঝামাঝিতে। তিনি বলেন, এই সময়ের পূর্বে, ইউরোপ ছিলো সামান্তবাদী এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ছিলো সম্পূর্ণ কৃষি নির্ভর।
১৩০০ সালের পরে ইউরোপের জলবায়ুগত পরিবর্তন ও বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের প্রভাবে ইউরোপের কৃষিখাতে এবং উৎপাদন ব্যবস্থা বাধা প্রাপ্ত হয়। ফলে, মানুষ চাহিদা পূরণে নির্ধারিত মূল্যে বাজার থেকে পণ্য ক্রয়ে করতে বাধ্য হয়। এভাবেই, ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা বণিকদের হাতে চলে যেতে থাকে যা আধুনিক বাজার ব্যবস্থা বা পুজিবাদের সূচনা ঘটায়। এভাবেই, ইউরোপের কৃষকরা বাজারে চাহিদা অনুযায়ী কৃষি পণ্য উৎপাদন করতে থাকে এবং বাজারে চাহিদা পূরণে বিভিন্ন শিল্প কারখানা চালু হতে থাকে।
এছাড়াও, ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখতে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। ফলে ইউরোপে ঔপনিবেশিক চেতনা জাগ্রত হয় এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ফেপে ওঠা ইউরোপীয় শক্তি নতুন বাজারের সন্ধানে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রযাত্রা করে, এবং দখলকৃত ভূখন্ডের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পরিবর্তে তার বাজার উপযোগী র্পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপনিবেশগুলো ঔপনিবেশিক শক্তির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবারহ করত। উপনিবেশে শিল্প-কারখানা ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্যেই স্থাপিত হত। ফলে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যখন তারা আত:প্রকাশ করে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ অনেক জটিল হয়ে ওঠে।
এভাবেই, বিশ্বব্যবস্থায় দুটি ভাগ তৈরি হয়। যথাঃ
১. পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যারা সবচেয়ে সুবিধাভোগী বা এই ব্যবস্থার প্রবক্তা তারা এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে (The Core) অবস্থান করে; এবং
২. যারা এই কেন্দ্রীয় শক্তির উপর বিভিন্ন প্রয়োজনে, বিশেষত অর্থনৈতিক প্রয়োজনে নির্ভরশীল তারা এই ব্যবস্থার একদম প্রান্তে (The Periphery) অবস্থান করে।
প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দেশ যেমন: ফ্রান্স, ব্রিটেন, এবং হল্যান্ডকে ঘিরে যে ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তা আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির কেন্দ্রে অবস্থান করে। এই কেন্দ্রীয় অঞ্চল (The Core Region) এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার ও বৃহৎ সামরিক ও বাণিজ্যিক শক্তি। বাণিজ্যিক শক্তি একটা দৃঢ় বুর্জুয়া গোষ্ঠি (যেমন: বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান) তৈরি করে যারা অতিরিক্ত মুনাফা লাভের সুবিধার্থে আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে।
পাশাপাশি, এই বুর্জুয়া এলিটরা বা প্রতিষ্ঠান শহর ভিত্তিক শিল্প-কারখানা তৈরি করে, ফলে কৃষি জীবিকা ছেড়ে অনেকে শহরমূখী হয়। এই প্রবণতা সিস্টেমের প্রান্তিক পক্ষের ক্ষেত্রেও একই থাকে। বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় পক্ষ পুঁজিবাদের পূজা করে। পুঁজি সঞ্চয় তাদের কর্ম-পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকে। তাদের তৈরিকৃত পদ্ধতিতে তারা প্রান্তিক পক্ষকে টেনে আনতে চায়। তাদের নকশা করা ব্যাংক, চাকুরি ও সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ও দক্ষতার আদলে প্রান্তিক পক্ষকেও গড়ে তোলার চেষ্টা করে, এবং প্রান্তিক পক্ষের শ্রমের প্রাচুর্য ও পুজিঁর স্বল্পতা-ই প্রান্তিক পক্ষকে, কেন্দ্রীয় পক্ষের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করে।
এই বিশ্ব ব্যবস্থা তত্ত্বে যাদের প্রান্তিক পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়- তাদের সরকার ব্যবস্থা কম শক্তিশালী, উৎপাদন উপকরণের অভাব, শ্রমের প্রাচুর্য রয়েছে। কেন্দ্রের কাঙ্খিত উৎপাদনে সহায়ক কাঁচামালের যোগান তারা দেন।
ষোড়শ শতকে লাতিন আমেরিকা ও পূর্ব ইউরোপ বিশ্ব ব্যবস্থার প্রধান প্রান্তিক অঞ্চলে হিসেবে বিবেচিত হত। লাতিন আমেরিকার স্থানীয় রাজনৈতিক কাঠামো ও সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দখলকারী স্পেনীয় ও পর্তুগীজ সাম্রাজ্য। স্পেন ও পর্তুগীজ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জায়গায় চাটুকারী ও দুর্বল শাসক নিবিষ্ট করে। লাতিন আমেরিকার স্থানীয় অধিবাসীদেরকে হয় হত্যা করা হয় অথবা দাস হিসেবে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয়।
অন্যদিকে, আফ্রিকার বিভিন্ন ভূখন্ড দখলের পর আফ্রিকানদের দাস হিসেবে লাতিন আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া এবং ভূমি ও খনিতে শ্রমিক হিসেব কাজে লাগানো হয়। লাতিন আমেরিকার পুতুল সরকার কেন্দ্রীয় ইউরোপীয়ানদের কল-কারখানা চালু রাখতে আমেরিকা হতে ইউরোপে কাঁচামাল সরবারহ করত।
কিন্তু প্রান্তিক অঞ্চলের কৃষিতে কেন্দ্রের যে এই নজরদারি তার প্রভাবে প্রান্তিক পক্ষ কৃষিক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে নি। কারণ স্থানীয়দের কেন্দ্রের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী অধিক ফসল ফলাতে হয়। ফলে স্থানীয় বাজারের চাহিদাকে অবদমন করতে হয়। যেমন: বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ যেখানে কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে তার টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারে, কিন্তু কেন্দ্রের বাজার চাহিদা, অর্থাৎ পোশাক শিল্পের মত অন্যান্য শিল্পে কেন্দ্রের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশকে সেই কৃষি সম্ভাবনাকে কম গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। এভাবে, বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের পথ আরও জটিল ও দীর্ঘ হচ্ছে।
বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্বে, কেন্দ্র ও প্রান্তিক পক্ষের মাঝে একটা মধ্যবর্তী পক্ষ আছে। অনেকক্ষেত্রে ভৌগলিকভাবে এই পক্ষ কেন্দ্রের কাছাকাছি হতে পারে, তবে কেন্দ্রের চেয়ে আর্থিক সক্ষমতা অনেক কম। তবে, এই কম প্রান্তিক পক্ষের চেয়ে বেশি। তারা মধ্যবর্তী হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে কেন্দ্র দ্বারা শোষিত হয়- কিন্তু কেন্দ্রের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে থাকায় প্রান্তিকপক্ষ থেকে বিবিধ সুবিধা আদায় করতে পারে। বস্তুত, মধ্যবর্তী পক্ষ (Semi-peripheral)- কেন্দ্র ও প্রান্তিক পক্ষের মাঝে বাফার হিসেবে কাজ করে।।
যাহোক, World System Theory আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থীদের সামনে যে বিভাজিত বিশ্ব উপস্থাপন করে, শিক্ষার্থীরা ক্রমেজ সে সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বিভক্তি যে কোন সময়ের চেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনুন্নত, দুর্বিষহ আফ্রিকা, অনুন্নত দক্ষিন এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা, উন্নয়নশীল আসিয়ান ও দূরপ্রাচ্য (চীন, জাপান, কোরিয়া) ইত্যাদির বিপরীতে পশ্চিমা চাকচিক্য, আর্থিক প্রতিপত্তি ও বিশ্ব ব্যবস্থার কলকাঠি নাড়া প্রভৃতি বিশ্ব ব্যবস্থার বিভাজনকে শিক্ষার্থীদের সামনে সহজ বাক্যে তুলে ধরে।
ভাবানুবাদ:
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল বই:
International Relations: The Key Concepts
By- Martin Griffith, Tarry O'Callagahan & Steven C. Roach


No comments