Header Ads

Header ADS

বিশ্বব্যাংক (World Bank) যেভাবে কাজ করে

 বিশ্বব্যাংকের (World Bank) যেভাবে কাজ করে


World Bank Logo


বিশ্বব্যাংকের (WORLD BANK) যাত্রা

IMF এর মত, ব্রেটন উডস সম্মেলনের একটি প্রোডাক্ট হিসেবে বিশ্বব্যাংক (WORLD BANK) যাত্রা সূচনা করে। বিশ্বব্যাংকের আসল নাম আন্তর্জাতিক পুনঃগঠন ও উন্নয়ন ব্যাংক (International Bank for Reconstruction and Development- IBRD)।  

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ প্রায় ৩৮ টি সদস্য নিয়ে IBRD বা বিশ্বব্যাংক ১৯৪৬ সালে যাত্রা শুরু করে। IBRD ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ও প্রধান লক্ষ্য ছিলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপকে পুনঃগঠনের প্রয়োজনে প্রচুর পরিমানের ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া। 

১৯৫০ ও ১৯৬০- এর দশকে এই ঋণের সুফল ইউরোপ অনুভব করে- এবং তারা নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করে। ফলে, ইউরোপে সফলতা IBRD কে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দিকে মনোযোগী হতে সাহায্য করে।  

এই অঞ্চলে আধুনিকতা ও উন্নয়ন ছড়িয়ে দিতে বিশ্বব্যাংক (WORLD BANK) একদিকে যেমন ঋণ প্রদান করে, অন্যদিকে, সেই ঋণের গ্যারান্টি হিসেবে নানা প্রযুক্তি ও কৌশলগত সহযোগিতা প্রদান করে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সুপারিশ করে, এবং রাজনীতিকে বাজার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়।  

বিশ্বব্যাংকের দেখানো পথে চলে এই অঞ্চলের মধ্যে গত শতকে আসিয়ান ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোই বেশি সুবিধা করতে পেরেছে। বর্তমানে প্রায় ১৯০টি দেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্য এবং বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। এছাড়াও, বিশ্বব্যাংক (WORLD BANK) জাতিসংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এজেন্সি হিসেবে কাজ করে। 


বিশ্বব্যাংক (WORLD BANK) এর সহযোগি অংশ 

১৯৫০ সাল পরবর্তী সময়ে IBRD ব্যাংককে সহযোগিতার প্রয়োজনে আরও চারটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। ১৯৫৬ সালে, IBRD'র প্রথম সহযোগি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা (International Finance Corporation- IFC) যাত্রা করে। IFC প্রতিষ্ঠানটির কাজের পরিধি খুব সীমিত। তাহল বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগিতা, বিশেষত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া যাতে অন্যান্য বেসরকারি বিনিয়োগ IFC-তে যুক্ত হতে পারে। 

IBRD-এর দ্বিতীয় সহযোগি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (International Development Association- IDA)-এর জন্ম হয়। IDA প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য IFC থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিলো। অর্থাৎ, বিশ্বের দারিদ্র-পীড়িত দেশগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদী সুদবিহীন ঋণের সুবিধা প্রদান করাই ছিল IDA প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য।  

কিন্তু, IFC ও IDA এর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সমস্যা তৈরি হয়, যার অধিক হয় IFC-এর ক্ষেত্রে। ফলে, IBRD-এর তৎপরতায় ভাটা পড়তে থাকে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে ১৯৬৬ সালে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সংকট নিরসন কেন্দ্র (International Centre for Settlement of Investment Disputes- ICSID) প্রতিষ্ঠা পায়। 

পরবর্তীতে, বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগক সুরক্ষার প্রশ্ন ওঠে, অর্থাৎ, বহুজাতিক কম্পানি অনেক ক্ষেত্রে দেউলিয়া হয়ে যায়- ফলে বিনিয়োগের মুনাফা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চেয়তা তৈরি হয়। এই অনিশ্চেয়তা কমাতে এবং বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে ১৯৮৮ সালে Multilateral Investment Guarantee Agency- MIGA প্রতিষ্ঠিত হয়। 


বিশ্বব্যাংকের (WORLD BANK) কাজের পরিধি 

তাত্ত্বিক বা নীতিগত (প্রিন্সিপাল) দিক বিবেচনায় বিশ্বব্যাংকের মূল লক্ষ্য সর্বজন সমাদৃত- তাহল তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্রতা প্রশমনে চেষ্টা চালানো, এই লক্ষকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাংক (WORLD BANK) তার বিভিন্ন প্যাকেজ বা থিক সাঁজায়। যেমনঃ বিশ্বব্যাংক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে ঋণগ্রহীতাকে সীমিত শর্তে ঋণ দেয়। 

এই ঋণের সিংহভাগই যায় ঋণগ্রহীতার বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে। যেমনঃ বাঁধ, প্রধান সড়ক নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বন্দর বা সেতুর মত বড় বড় প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়। 

তবে IDA সংস্থাটি ক্ষুদ্র পরিসরে উন্নয়ন কাজেও ঋণ দেয়। যেমনঃ পাণি পরিশুদ্ধকরণ, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য, পরিবার-পরিকল্পনা, কৃষি উৎপাদন, যুব সমাজের দক্ষতা উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়। 

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক এসব প্রকল্পের একটা নির্দিষ্ট পরিমানে ঋণ দেয়। অর্থের বাকী যোগান আসে বেসরকারি বিনিয়োগ, শুল্ক-কর, এবং রাষ্ট্রের নিজস্ব তহবিল থেকে। 


বিশ্বব্যাংকের অর্থের উৎস

বিশ্বব্যাংকের অর্থের যোগানও আসে বিভিন্ন উৎস থেকে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিশ্বব্যাংক অর্থ সংগ্রহ করে। এছাড়াও ঋণের উপরে ঋণগ্রহীতা দেওয়া সুদ হতে এবং বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থের যোগান হয়।

এছাড়াও, বহুজাতিক কোম্পানি, ইনসুরেন্স কোম্পানির কাছে বিশ্বব্যাংক (WORLD BANK) হুন্ডি বিক্রি করে বিশাল পরিমাণের মুনাফা পায় এবং বিভিন্ন ভাতা সংস্থাও বিনিয়োগ হিসেবে বিশ্বব্যাংকে তাদের অর্থ জমা রাখে। 

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাংকের সর্ববৃহৎ আর্থিক যোগানদাতা। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংকের মোট অর্থের প্রায় ২০ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের অর্থের যোগান প্রায় ৩১৮ বিলিয়ন ডলার যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৫৫-৫৬ বিলিয়ন ডলারের সমান। 


বিশ্ব ব্যাংকের কাঠামো

২২ জন পরিচালক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স- বিশ্বব্যাংকের সর্ববৃহৎ ডোনার হিসেবে এই ২২ জনের মধ্যে ৫ জন পরিচালক তারাই নিয়োগ দেয়, এবং বাকিরা (১৭ জন পরিচালক) সদস্যদের কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। 

এই ২২ পরিচালকের উপরে রয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট (পাঁচ বছর মেয়াদী) এবং পরিচালনা পর্ষদ যেখানে বিশ্বব্যাংকের প্রতিটি সদস্যই প্রচলিতভাবে সদস্যপদ লাভ করে, এবং প্রত্যেকে একটি করে ভোট দিতে পারে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নিয়ম ভিন্ন, সে অন্যদের তুলনায় বেশি ভোট প্রদানের সুবিধা পায়। 


বিশ্বব্যাংককে ঘিরে সমালোচনাঃ 

তাত্ত্বিক দিকের বাহিরে, ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, বিশ্বব্যাংক (WORLD BANK) নানাভাবে সমালোচিত হয়। অনেকে মজা করে বিশ্বব্যাংককে "ভেড়ার বেশে দুষ্টু নেকড়ে! (Wolf in Sheep's Clothing!)" বলে সম্বোধন করেন। কারণ, সমালোচকদের ভাষায়, বিশ্বব্যাংক (WORLD BANK) তৃতীয় বিশ্বে দারিদ্র নিরসনের বদলে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রথম বিশ্বের নিয়ন্ত্রাধীণ করতে সাহায্য করে। 

বা এভাবে বলা যায়, উন্নত পুঁজিবাদী বিশ্ব নিজেদের মুনাফাবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করতে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতা, অভাব ও অদক্ষতা দূরীকরণের ট্যাগ সামনে রেখে তৃতীয় বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, এবং বিশ্বব্যাংক নামের প্রতিষ্ঠানটি এ লক্ষ্য অর্জনে ১ম বিশ্বের দেশদের সাহায্য করে যাচ্ছে।

বর্তমানে, তৃতীয় বিশ্বে অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি কিছু কিছু দেশের জন্য বিশ্বব্যাংক  গলার কাটা বা লস প্রজেক্ট হয়ে দেখা দিয়েছে । অর্থাৎ, বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের পূর্বে তাদের যে মাথাপিছু আয় ছিলো, বর্তমানে তা অনেক কমে গিয়েছে!  

UNTAD এর একটা পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে যেখানে ১৯৮০ সালে বিশ্বের ১৩ কোটি মানুষ ঋণগ্রস্থ ছিলো, ২০০৫ সালে তার পরিমাণ ২১ কোটিতে পৌছলো, এবং বর্তমানে সেই সংখ্যা প্রায় ২৬ কোটি। উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়টি হল, অপরিশোধিত ঋণ পরিশোধে বিশ্বব্যাংক পুনরায় ঋণখেলাপী দেশকে ঋণ প্রদান করে থাকে, যা লাভের বদলে ক্রমে ঋণগ্রহীতার জন্য ফাঁদ হিসেবে পরিগণিত হয়।    

বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প ভিত্তিক মানসিকতা- বড় প্রকল্প ছাড়া আর্থিক সাহায্য না দেওয়া, এটিও বিশ্বব্যাংককে সমালোচনার একটি বড় কারণ। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই তৃতীয় বিশ্বের দেশের বেশি ঋণ প্রয়োজন- বিশেষত নারীদের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নে। 

বর্তমানে বিশ্বব্যাংক এই সমালচোনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে এবং সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে। বিশেষত, নারীদের অবস্থা উন্নয়ন ও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি সম্পর্কিত প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রধানের সম্মতি প্রদান করে। 

এছাড়াও, বিশ্বব্যাংক (WORLD BANK) যে দাতা রাষ্ট্রের স্বার্থে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কাজ করেছে এবং করে আসছে তা বলাই বাহুল্য। তাই বিশ্বব্যাংক সবসময়ই সমালোচিত হবে- কখনো সার্বজনীন হতে পারবে না। কারণ এই ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক যে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিক্রমার নিয়ন্ত্রকও সে!- যুক্তরাষ্ট্র। 

তাই প্রায়শই দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় পলিসি এই ব্যাংকের কার্যক্রমের উপর প্রভাব বিস্তার করে। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র যখন কোন রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন বিশ্বব্যাংক সেই দেশকে ঋণ দিতে চায় না, দিলেও অনেকগুলো শর্ত জুড়ে দেয়। 


উপসংহারঃ 

তবুও, এটা অর্থনীতিবিদেরা স্বীকার করেছেন যে তৃতীয় বিশের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকাকে অস্বীকারের জো নেই। অন্তত, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এই ব্যাংকের একটি বড় জায়গা। এছাড়াও, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের বর্তমান ভূমিকা ইতিবাচক, আশা করা যায় তা সুদূর প্রসারী হবে। 



ভাবানুবাদকঃ 

বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়  

 

মূল বই: 
International Relations: The Key Concepts 
By- Martin Griffith, Tarry O'Callagahan & Steven C. Roach

      


  

      

1 comment:

  1. সহজ ভাষায় অনেক সুন্দর উপস্থাপন

    ReplyDelete

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.