Header Ads

Header ADS

লেবাননে কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে? এরপর কী?

 লেবাননে কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে? এরপর কী?




গত কয়েক সপ্তাহে লেবাননে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটেছে যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দিয়েছে। পেজার ডিভাইসে বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। 

লেবাননে অথবা বৃহৎ পরিসরে মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে, কিংবা এরপরই বা কী - এ প্রশ্নগুলো বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির একজন একনিষ্ঠ পাঠক ও পর্যবেক্ষক হিসেবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কার্যকারণ এবং উপরের প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছি। 

নিম্নে এ বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু মতামত ও বিশ্লেষণ তুলে ধরছি:
১। লেবাননের প্রতিরোধ গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ গত তিন দশক ধরে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম নন-স্টেট বাহিনী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। ইসরায়েলের গোয়েন্দাজাল এড়িয়ে তাদের সাংগঠনিক ও সামরিক সম্প্রসারণ তাদেরকে একটি পরাক্রমশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলে। 

কিন্তু দৃশ্যত গত কয়েক মাস বা বছর ধরে ইসরায়েল তাদের গোয়েন্দাজালে হেজবুল্লাহকে বেঁধে ফেলে। হেজবুল্লাহর কমিউনিকেশন্স, কমান্ড এন্ড কন্ট্রোলে ইসরায়েলী গোয়েন্দারা প্রায় নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এর প্রথম প্রমাণ ধরা পড়ে ইসরায়েলী গোয়েন্দারা শেল/ভুয়া কোম্পানীর মাধ্যমে তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সহযোগীতায় হেজবুল্লাহ’র পেজার কমিউনিকেশন্স ডিভাইস সরবরাহ ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ এবং ডিভাইসগুলোতে গোপনে বিস্ফোরক প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে। হেজবুল্লাহ ইসরায়েলীদের এই গোয়েন্দা কার্যক্রম শনাক্ত ও প্রতি-ব্যবস্থা গ্রহণে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। 

২। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে ইসরায়েল একযোগে প্রায় পাঁচ হাজার পেজার ডিভাইসে রিমোট কন্ট্রোল্ড বিস্ফোরণ ঘটায় এবং পরের দিন আরও কয়েকশ’ ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণ ঘটায়। ইসরায়েলী ও পশ্চিমা গোয়েন্দাদের নজরদারি এড়িয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখতে হেজবুল্লাহ’র সদস্যরা স্মার্টফোন বা অন্যান্য আধুনিক যোগাযোগ উপকরণ ব্যবহার না করে এনালগ প্রযুক্তির পেজার ডিভাইস/ বীপার ব্যবহার করে। এগুলোতে কোন বার্তা আদান-প্রদান হয় না (কেবল কোন বার্তা গ্রহণ করা যায়) বিধায় এগুলো কোন সিগনাল ট্রান্সমিট করে না, যার ফলে পেজার ডিভাইস নজরদারি করা যায় না। 

হেজবুল্লাহ’র সদস্যরা মূলত তাদের কমান্ডারদের আদেশ/ বার্তা গ্রহণের জন্য পেজার ডিভাইস ব্যবহার করতো। যদিও সীমিত সংখ্যক পেজার ডিভাইস বেসামরিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও ব্যবহার করতো। এতটা সতর্কতা অবলম্বন করার পরও পেজার ডিভাইস ও ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণের পর হেজবুল্লাহ’র আভ্যন্তরীণ কমিউনিকেশন্স, কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। হেজবুল্লাহ’র হাজার-হাজার সদস্য কার্যত পরস্পর থেকে, এবং নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

৩। ইসরায়েলের জন্য এটি ছিলো মোক্ষম সুযোগ। হেজবুল্লাহ’র পাল্টা হামলা চালানোর সামরিক সক্ষমতার ব্যাপারে ইসরায়েল ওয়াকিবহাল। কিন্তু হেজবুল্লাহ’র যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় তারা যেকোনো ইসরায়েলী আগ্রাসনের জবাব দিতে প্রায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ইসরায়েল এই সুযোগটিই নিয়েছে এবং হেজবুল্লাহ’র সদরদপ্তরে হামলা করে হাসান নাসরুল্লাহ ও প্রায় দুই ডজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এটি অনুমেয় যে পেজার ডিভাইস বিস্ফোরণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট না হলে ইসরায়েল নসরুল্লাহ’র ওপর আক্রমণের সাহস করতো না। 

স্পষ্টত হেজবুল্লাহ’র অবস্থা এই মুহূর্তে সিটিং ডাক-এর মতো। প্রায় দেড় লক্ষাধিক মিসাইল, কয়েক ডজন ব্যালিস্টিক মিসাইল, কয়েকশ’ বিপজ্জনক এন্টি-শীপ মিসাইল ও হাজার-হাজার ড্রোন থাকার পরও এবং পাল্টা আক্রমণের বড় ধরনের সক্ষমতা থাকলেও হেজবুল্লাহর সদস্যদের নির্দেশ দেওয়ার কেউ নেই এবং তাদের কাছে নির্দেশ পৌঁছানোরও এই মুহূর্তে কোন বন্দোবস্ত নেই। হেজবুল্লাহ’র জন্য এটি ভয়াবহ আঘাত। তারা প্রতিষ্ঠার পর থেকে এত বড় সংঘবদ্ধ আক্রমণের মুখে পড়েনি।

কার কী ভূমিকা? 

৪। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সমরাস্ত্র ও অর্থের যোগান দাতা। তারা গোয়েন্দা সহযোগিতা, কূটনৈতিক সহযোগিতাসহ যাবতীয় সহযোগিতা করে যাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের প্রধান পৃষ্ঠপোষকতাকারী হিসেবে গত ৭০ বছর দেশটিকে সহযোগিতা করে গেছে। ধর্মীয় কারণ ছাড়া ইসরায়েলি জেনোসাইডাল রাষ্ট্রটির প্রতি তাদের এই অন্ধ সমর্থনের পক্ষে আর কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া দুস্কর। 

ইরান হেজবুল্লাহ’র সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু ঘটনার আকষ্মিকতায় দৃশ্যত তারাও বিহ্বল হয়ে পড়েছে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট রইসির রহস্যজনক মৃত্যুর পর সমালোচকরা নতুন সরকারকে দুর্বল ও আপোষকামী হিসেবেই গণ্য করছে। আভ্যন্তরীণ দৃশ্যমান দুর্বলতার ফলে ইরান তার মিত্রের সহযোগিতায় সক্রিয়ভাবে আসবে না বলেই প্রতীয়মান। ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকরা ইরানের এই দুর্বলতার সুযোগও পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করেছে।

৫। প্রশ্ন উঠতে পারে এর পর কী হবে? আমি মনে করি দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে। স্বল্প মেয়াদে, ইসরায়েল হেজবুল্লাহ’র এই হতবিহ্বলতার সুযোগ নিয়ে সম্ভবত দক্ষিণ লেবাননে সৈন্য পাঠাবে এবং তারা সাময়িক সামরিক সাফল্যও লাভ করবে। ইসরায়েল জানে যে হেজবুল্লাহ তার মিত্রদের সহযোগিতায় আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। যেকারণেই ইসরায়েল সে সময় দিতে চাইবে না। সংগঠনটির বর্তমান বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবে। কতটুকু সফল হবে সেটি সময়ই বলে দেবে।

দীর্ঘমেয়াদে, প্রতিক্রিয়াটি হবে বহুমূখী। পেজার ডিভাইসের সরবরাহ ব্যবস্থায় ইসরায়েলীদের অনুপ্রবেশ এবং বিস্ফোরক প্রতিস্থাপন পশ্চিমা প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি সম্পর্কে সারা বিশ্বে সন্দেহ ও সংশয় বাড়াবে। পশ্চিমা প্রযুক্তি ব্যবহারের এই ঝুঁকি পশ্চিমা ক্যাপিটালিজমের জন্যও ঝুঁকি এবং পশ্চিমা প্রযুক্তি কোম্পানীগুলোর জন্য একটি বড় ধাক্কা নিয়ে আসবে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার বহু দেশ তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় পশ্চিমা প্রযুক্তি ক্রয় ‍ও ব্যবহার থেকে যথাসম্ভব সরে আসতে চাইবে। চীনা কোম্পানীগুলো এ শূন্যস্থান দখল করবে।

হেজবুল্লাহ এই ধাক্কা সামলে উঠতে দীর্ঘ সময় নিবে। খুব সম্ভবত লেবাননে ইসরায়েল, তার পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষক, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের যৌথ মদদে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত শুরু হবে ও দীর্ঘ মেয়াদী অস্থিরতা শুরু হবে। ইরানীয়রা হুতি ও ইরাকী প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে শক্তিশালী করায় মনোযোগ দিবে এবং জর্ডানে নতুন প্রতিরোধ ফ্রন্ট খুলবে। ইরান জানে যে ইসরায়েলের সাথে সরাসরি সংঘাতে তাদেরকে আমেরিকার সামরিক বাহিনীকেও মোকাবেলা করতে হবে যার সম্মিলিত সক্ষমতাকে মোকাবেলার সামর্থ্য তাদের নেই। সেজন্য তারা সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলে  হামলা অব্যাহত রাখবে। 

ইরান সম্ভবত রাশিয়া ও চীনের সাথে সামরিক জোটে যুক্ত হবে ও পারমাণবিক বোমা তৈয়ার করবে। তারপরও তারা বিশ্বে আমেরিকার উল্লেখযোগ্য শক্তিক্ষয় ছাড়া ইসরায়েলে আক্রমণ করবে না। তুরস্ক জনগণের চাপে ইসরায়েল বিরোধী অবস্থান জোরদার করতে চাইবে, যদিও পশ্চিমা ন্যাটো জোটে তাদের অবস্থানের কারণে স্বল্প বা মধ্য মেয়াদে তাদের দিক থেকে ইসরায়েলের প্রতি উল্লেখযোগ্য হুমকির সম্ভাবনা নেই। দীর্ঘমেয়াদে তারা ন্যাটো জোট পরিত্যাগ করতে পারে এবং তখন মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ইসরায়েল-বিরোধী সামরিক সক্রিয়তা পরিলক্ষিত হতে পারে।


লেখাটি সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া স্যারের ফেজবুক পোস্ট থেকে নেওয়া হয়েছে। 

No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.