Prisoner of Geography বইয়ের ভূমিকা
Prisoner of Geography বইয়ের ভূমিকা
![]() |
| Prisoners of Geography by Tim Marshall |
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজেকে একজন সাচ্চা ধার্মিক এবং রাশিয়ার অর্থডক্স চার্চের বড় অনুসারী হিসেবে দাবি করেন। ঘটনা যদি আসলেই তা হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিতভাবে প্রতিরাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময়ে পুতিন ইশ্বরের কাছে একটি সওয়াল করে থাকবেন, “হে ইশ্বর, কেন তুমি ইউক্রেন ও রাশিয়ার মাঝে কোনো পর্বতশ্রেণী সৃষ্টি করনি?”
ইশ্বর যদি ইউক্রেন ও রাশিয়ার মাঝে পর্বতশ্রেণী সৃষ্টি করতো, তবে রাশিয়াকে উত্তর ইউরোপীয় বিস্তর সমভূমি নিয়ে দুশ্চিন্তা বা এই পথ ধরে ইউরোপীয় শক্তিদের হাতে বারবার আক্রান্ত হতে হতো না। ফলে, ভৌগোলিক বিবেচনায় রাশিয়াকে সামরিক শক্তি বাড়াতে হল, যাতে এ বিস্তর সমভূমি অঞ্চলের উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পায় বা রাশিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা সুরক্ষিত থাকে। রাশিয়ার এরূপ সমীকরণ শুধু উত্তর উত্তর ইউরোপের সমভূমিকে নিয়ে নয়, উপরন্তু এই সমভূমিকে ঘিরে থাকা ক্ষুদ্র বা বৃহৎ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একই। একইভাবে, রাশিয়ার এই ক্ষুদ্র বা বৃহৎ প্রতিবেশী সরকারেরাও একই ধরনের চাপ অনুভব করে।তবে, সে চাপটি হল বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার প্রভাব থেকে নিজ নিজ রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখা।
অর্থাৎ, কিছু রাষ্ট্র তার ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় কখনো নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছেন, আবার কখনো নিজের ভৌগোলিক কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন। এ ভৌগোলিক সত্য ঐতিহাসিক। সে প্রাচীন এথেনীয় সাম্রাজ্য, পারসিয়ান সাম্রাজ্য, ব্যবলনীয় সাম্রাজ্য, বা তার আরও পূর্বের প্রাচীন সভ্যতা অথবা স্থানীয় গোত্রব্যবস্থা প্রভৃতি সকল সময়ে ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাব প্রতিটি রাজনৈতিক সত্বা সে হোক রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য বা গোত্র ইত্যাদি সবাইকে প্রভাবিত করেছে।
ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাব যে শুধু রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র পরিচালনায় জড়িতদের উপরে পড়ে তা কিন্তু নয়, ভূখণ্ড আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকেও প্রভাবিত করে। এর প্রভাব পরে যুদ্ধে, ক্ষমতা বৃদ্ধি বা হ্রাসে, রাজনৈতিক ও কৌশলগত সমীকরণে, মানুষের সামাজিক জীবন পরিচালনায়, এবং মোটাদাগে পৃথিবীর প্রতিটি অনুষঙ্গে। প্রযুক্তির বিকাশে আমাদের মানুসিক ও ভৌত (Physical) দূরত্ব অনেকাংশেই দূরীভূত হয়েছে।
তবে, যে ভূখন্ডে মানুষের জন্ম, বেড়ে ওঠা, প্রজন্মের ধারা বয়ে চলা, যে ভূখন্ডে শত শত কোটি মানুষের বসবাস, সে ভূখন্ডের ভৌগোলিক অবস্থান ও ভৌগোলিক কাঠামো যেমন বয়ে চলা নদী, থামিয়ে দেওয়া পর্বতশ্রেণী, দিগন্তজুড়ে গভীর হ্রদ, এবং সাগরের জলরাশি প্রভৃতি মানুষকে আটকে রাখে, মানুষের মনকে প্রভাবিত করে।
সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে ভৌগলিক প্রতিটি উপাদান (Factors) সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি পর্বতের গুরুত্বকে যেমন মরুভূমি বা মালভূমির তুলনায় খাটো করে দেখতে পারেন না, তেমনি নদীর গুরুত্বকে জঙ্গলের তুলনায় তুচ্ছভাবার কোন কারণ নেই। ভৌগলিক উপাদান বিশ্লেষণে মানুষ বুঝতে পারে সে কোনটি করতে পারবে, আর কোনটি পারবে না।
যদি আরও খোলাসা করে বলি, ভৌগলিক উপাদান কিভাবে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিকে প্রভাবিত করে তা ভূরাজনৈতিক বয়ানে স্পষ্ট হয়। এখানে ভৌগলিক উপাদান শুধু নদী, সমুদ্র বা পর্বতের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, উপরন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলবায়ু, মানবগোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্তিও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিকে কিভাবে প্রভাবিত করে ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণে সে বিষয়গুলো ফুটে ওঠে। এ উপাদানের প্রভাব পরেছে আমাদের সভ্যতায়, আমাদের সামরিক কৌশলে, আমাদের সামাজিক জীবন যাপনে, আমাদের প্রত্যাহিক অনুষঙ্গে যেমনঃ ভাষায়, বাণিজ্যে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসে।
তবে, ভৌগলিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিক্রমায় যে পরিবর্তন এসেছে বৈশ্বিক ইতিহাস রচনায় তাকে সেভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়নি। বিশ্ব রাজনীতিতে চলমান ঘটনাপ্রবাহের কার্যকারণ বিশ্লেষণে অর্থাৎ, ভৌগলিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে “কী” বা “কেন” দ্বারা প্রশ্ন করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভৌগলিক উপাদানের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এর বড় উদাহরণ চীন ও ভারত। বিশাল জনসংখ্যার দেশ দুটির দীর্ঘ সীমানা উভয়ের দীর্ঘ বিরোধের কারণ। এ সীমানা রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কোন উপাদান বিবেচনায় অঙ্কিত হয়নি। তাই সীমান্ত বিরোধ দুই বৃহৎ প্রতিবেশির নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। তবে, উভয়ের মাঝে সীমানা নিয়ে যুদ্ধ হয়েছিলো একবার- সেই ১৯৬২ সালে, উভয়ে আর কোন যুদ্ধে জড়ায়নি যদিও যুদ্ধের উত্তেজনা অনেকবারই দেখা গিয়েছে। কিন্তু কেন এই দুই বৃহৎ শক্তি দ্বিতীয়বার আর যুদ্ধে জড়ালো না।
এর অন্যতম কারণ এই প্রতিবেশীর মাঝে সীমারেখা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয় পর্বতশ্রেণী। তাই, এই দানবাকৃতির পর্বতশ্রেণি ডিঙিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ও নিস্ফল। দেশ দুটি সামরিক প্রযুক্তিতে আধুনিক হয়ে উঠলেও, ভৌগোলিক বাধা পেড়িয়ে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে উভয়ের মাঝে এই বাধাকে একটি বাফার হিসেবে রাখতে চায়। তাই, এই বৃহৎ শক্তি দুটি তাদের আঞ্চলিক অন্য রাষ্ট্র কেন্দ্রিক বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করলেও, সে বাফার অঞ্চলের দিক থেকে দৃষ্টি কিন্তু ফিরায় না।
তবুও নিত্যনতুন সংকটের জন্ম হচ্ছে চীন ভারত সীমানায়। রাজনৈতিক দলের আদর্শ, লক্ষ্য, নেতৃবৃন্দের বয়ান এবং এছাড়াও অন্যান্য বিষয় এই সীমানায় সংকটের জন্ম দিচ্ছে, তবে তা অনেকাংশে স্বল্পকালীন। উভয় দেশের প্রতিটি প্রজন্মই হিন্দুকুশ ও হিমালয়ের প্রাকৃতিক বাধাকে মাথায় রেখেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পরিচালনার নীতি প্রণয়ন কররে থাকে। শুধু এই প্রকৃতি নয়, সাথে বিবেচ্য থাকে এ অঞ্চলের জলবায়ুর ধরণ ও খাদ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা।
সাংবাদিক হিসেবে ১৯৯০ এর বলকান যুদ্ধের যখন সংবাদ প্রকাশের প্রয়োজনে তথ্য সংগ্রহ করছি, তখন হঠাৎ একটা ভাবনা মাথায় ঝেকে বসে: বিশ্ব রাজনীতির গতিপ্রকৃতিকে ভৌগোলিক মানচিত্র কিভাবে বা কতটা প্রভাবিত করতে পারে? এই বিষয়ে লেখালেখি তো করাই যায়!
যুদ্ধে আমাকে বলকানের সার্বিয়ান, ক্রোশিয়ান, বশনিয়াক প্রভৃতি সংঘাতে জড়ানো দল নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। এই অঞ্চলের এই জনসংখ্যাগত বিভাজন এটি অনেক পুরাতন। কিন্তু বিংশ শতকে যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তারা যুগোস্লাভ পরিচয়ে পরিচিত হতেন। তবে সোভিয়েতের পতনে কৃত্রিম রাষ্ট্র যুগোস্লাভিয়ায় ভাঙন শুরু হয়। এক দল অন্যকে বলকান অঞ্চলের বহিরাগত হিসেবে উল্লেখ করতে থাকলে সংঘাতের সূচনা ঘটে। এই সংঘাতের বড় অনুষঙ্গ ছিলো ধর্মভিত্তিতে বিভাজন। যার নিকৃষ্ট উদাহরণ বসনিয়ার মুসলমানদের গণহত্যা।
ইতিহাসের আলোকে বলকান অঞ্চলকে বিশ্লেষণ করলে ইবার নদী থেকে শুরু করতে হয়। ১৩৮৯ সালে ইবার নদী তীরবর্তী শহর মিত্রভিকায় (Mitrovica) কসোভো যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হওয়ার পর সার্বিয়া অটোম্যানদের হাতে আসে। ক্রমেই সার্বরা ইবার অববাহিকা ত্যাগ করতে থাকে, এবং এই শূন্যস্থানে মেলিসিজা (Malesija) পর্বতের অধিবাসী আলবেনীয়রা পূরণ করে। সময় বয়ে চলে, বিংশ শতকের শেষের দিকে ইবার নদীর অববাহিকায় ধর্ম ও নৃগোষ্ঠী কেন্দ্রিক বিভাজন চরমে গিয়ে পৌছে। ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর বিমান হামলা ও কসোভো স্বাধীনতাকামী দলের পদাতিক সেনাদলের তোপের মুখে সার্বিয়ানরা যুদ্ধে ইস্তফা দিয়ে ইবার অববাহিকা থেকে পিছিয়ে যায়। সাধারণ সার্বিয়ানরাও একই পথ অনুসরণ করে। এভাবে ইবার নদী বলকান অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে একটি ডি ফ্যাক্টো সীমারেখা হিসেবে স্বীকৃতি পায়, এবং কসোভো স্বাধীনতা লাভ করে।
মিত্রভিকা শহর এমন এক জায়গায় যেখানে ন্যাটোও থামতে বাধ্য হয়। কসোভো ও সার্বিয়ার যুদ্ধের তিন মাসে পরিস্থিতি এমন ছিলো যে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি ন্যাটো গোটা সার্বিয়া দখল করে নিবে। বস্তুত, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ন্যাটোর নেতৃবৃন্দের কাছে গোটা সার্বিয়া দখল করবে সে সুযোগ ছিলো না। হাংগেরি পরিষ্কার ভাষায় ন্যাটোকে জানিয়ে দেয় হাংগেরির ভূমি ব্যবহার করে সার্বিয়া দখলে ন্যাটোকে সে সাহায্য করবে না।
এই বয়ানের পিছনে একটি শক্ত কারণ ছিলো: হাংগেরি ভয় পাচ্ছিলো গোটা সার্বিয়া যদি ন্যাটো দখল করে নেয়, তাহলে উত্তর সার্বিয়ায় যে প্রায় ৩৫০,০০০ হাংগেরীয় বসবাস করে তারা বাধ্য হয়ে হাংগেরিতে ফিরবে এবং তাতে অভ্যন্তরীণ সংকট সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ন্যাটোর হাতে দক্ষিণ দিক দিয়ে সার্বিয়ার বাকী অংশ দখল করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ ছিলো না। কিন্তু সেক্ষেত্রে ন্যাটোকে ইবার নদীর দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। যখন নদী শেষ হবে, তারপর আবার পর্বত পাড় হতে হবে যা এক কথায় দু:সাধ্য ব্যাপার।
বেলগ্রেডে যে সার্বদের সাথে আমি কাজ করতাম তারা সহসাই বলে উঠতো “কি হবে যদি ন্যাটো সার্বিয়ার বাকী অংশও দখলে নেয়? তখন আমাদের ক্যামেরা ছেড়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে!” তারা মানুষ হিসেবে অমায়িক, স্বাধীনতাকামী, আর চিন্তাচেতনায় উদার। তারা সার্বিয়ান শাসকদের বিরোধিতা করে। কিন্তু, তবুও মানচিত্র হাতে তাদের অনেকখানি নিশ্চিন্ত মনে হয়। দুর্গম পর্বতশ্রেণী সার্বদের ন্যাটোর আক্রমণ থেকে বাঁচালো। তখন আমারও ভালো লাগলো এটা ভেবে যে সার্বিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান ন্যাটোকে থামিয়ে দিয়েছে, যদিও ব্রাসেলসের মিডিয়ায় ন্যাটোর আক্রমণের পক্ষে তখনও প্রচারণা চালাচ্ছে।
ভৌগোলিক পরিবেশ একটা অঞ্চলের জন্য, একটা রাষ্ট্রের জন্য, একটা জনসংখ্যার জন্য কতটা সহায়ক কসোভো স্বাধীনতার ইতিহাস আমাকে সেই শিক্ষা দিয়েছে যার রেশ আমার বাকী সময়েও অনেক কাজে দিয়েছে। যেমন ধরুন ২০০১ সালের ৯/১১ ও তার পথ ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর আফগানিস্তানে আক্রমণ। আফগান যুদ্ধও আমাকে দেখিয়েছে পৃথিবীর আধুনিকতম প্রযুক্তি ও শক্তিশালী- প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী আফগানিস্তানের বৈচিত্র্যময় ভূমিতে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
প্রকৃতির কাছে প্রযুক্তিগত দক্ষতা কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমি ছিলাম উত্তর আফগানিস্তানে। যুদ্ধের মাঝামাঝি আমি কখনো খচ্চরের ও কখনো ঘোড়ার গাড়িতে করে তাজিকিস্তান- আফগানিস্তান ঘেষা এক খরোস্রতা নদীতে ভেলায় ভেসে অপর পারের নর্দান এলাইয়েন্সের সাথে যোগাযোগ করি। তখন তালিবানদের সাথে নর্দান এলাইন্সের তুমুলযুদ্ধ চলছে।
আফগানিস্তানের আকাশ আমেরিকার যুদ্ধবিমানে ছেয়ে গেছে, তারা সম্ভাব্য বিভিন্ন টার্গেটে বোমা হামলা চালাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য তালেবান ও আল-কায়দাকে আফগানিস্তানের ঠান্ডা, ধুলা জমে থাকা পাহাড়ি ভূখণ্ড মাজার-ই শরিফে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা। মিশনে সফল হয়ে আমেরিকান সেনাবাহিনী দক্ষিণ আফগানিস্তানের দিকে রহনা হয়, এবং ততক্ষণে গোটা বিশ্বে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ দমনে মার্কিন বাহিনীর সফলতার বয়ান ছড়িয়ে পড়েছে।
জীবনের খুব ভয়ের এক অভিজ্ঞতা হয়েছিলো আফগানিস্তানে। এত নিষ্ঠুর ও তীব্র বালু ও ধূলোর ঝড় আমি আগে দেখি নাই। তা সমগ্র অঞ্চলকে হলদে করে ফেলে। ঝড়ের তীব্রতা বাড়তে থাকে। সামনে কয়েকফুট দূরে থাকা দৃশ্য যেন কেমন অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। তখন আমেরিকার আধুনিক প্রযুক্তির কার্যক্ষমতা যে এই প্রাকৃতিক অবস্থার সামনে কতটা নাজুক তা পরিস্কার হয়ে ওঠে। মনে হয় গোটা আমেরিকা হয়তো থমকে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ উইলিয়াম বুশ আর তার দক্ষ নর্দান এলাইন্সের জেনারেলরা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে স্বাভাবিক পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
কিন্তু কি ভাগ্য! আকস্মিক বালু ঝড়ের ন্যায় হঠাৎ তুমুল বৃষ্টির আবির্ভাব শুষ্ক ধুলো ও বালুর স্তুপকে কাদায় পরিনত করে। বৃষ্টির তোরে স্তুপের আকার কেমন যেন চোরাবালির মত মনে হয়, স্তুপের শীর্ষভাগ কিভাবে যেন নিজের গভীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ফলে, আরও একবার নর্দান এলাইন্সকে তার দক্ষিণ যাত্রাকে রথ করে আফগানিস্তানের ভালোরূপ ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা করতে হল। আফগানিস্তানের যে প্রাকৃতিক বৈচিত্রের কথা হানিবল, সানজু, এমনকি গ্রীক মহাবীর আলেক্সান্ডারের জীবনী ও লেখনী থেকে পাওয়া যায়, আমেরিকানদের সামনে সে দৃশ্য বর্তমানে হুবুহু অপরিবর্তিত ও স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
২০১২ সাল, আমি আবারও ভূগোল থেকে শিক্ষা লাভ করি। সে মূহুর্তে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সবচেয়ে জটিল ও ধ্বংসাত্মক পরিণতিতে রূপ নিয়েছে। তখনকার কোন এক সকালে আমি সিরিয়ার এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দক্ষিণ সিরিয়ার হামা শহরের দিকে তাকিয়ে। আমার নজর কারলো দূরে পুড়ে ভস্ম হতে থাকা একটি হেলমেটের দিকে। আমার সিরিয়ান কিছু বন্ধু দূরে এক উপত্যকার দিকে আঙুল দিয়ে বলল এই আঘাতটি ঐ অর্ধ-মাইল দূরের গ্রামটি থেকে এসেছে।
তারা আমাকে ব্যাক্ষা করে বুঝালো যে ঐ দূরের উপত্যকাটিকে যদি কোন একটি দল দখল নিতে পারে তাহলে এই গোটা অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, এমনকি সে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র পরিচালনার ভূ-কৌশলগত সুবিধা পেয়ে যেতেও পারে, যদিনা সিরিয়ার আসাদ সরকার উপত্যকাটিকে পূনরায় অধিকারে নেয়। যেখানে কিছুক্ষণ আগেও আমি তাকিয়ে একটি জলন্ত হেলমেট আমি দেখেছিলাম, সেখানে আমি পুনরায় যতবারই তাকিয়েছি উপত্যকাটির শুধু ভূ-প্রকৃতি ও ভূ-কৌশলগত গুরুত্বের বিষয়টিই আমার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে! আমি আবারও অনুধাবন করলাম ভৌগোলিক অবস্থান রাজনৈতিক সমীকরণে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
তাই যুদ্ধে জয়ী হতে নয়, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটেও ভূরাজনীতি অতি গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে এরূপ উদাহরণ অহরহ মিলবে। তবে বইয়ে আমি এই প্রচুরকের সামান্য অংশই আলোচনা করেছি। এক্ষেত্রে আমি বিশ্বরাজনীতিকে এবং সে রাজনীতিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করা কিছু ভৌগোলিক মানচিত্রকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। এছাড়াও, এখানে ইতিহাসের একটি যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছি। এখানে জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে বর্তমান ইউরোপের দুর্যোগ রাশিয়া ইউক্রেন সংকটের বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়েছে। তাছাড়া, চীন-ভারতের দ্বন্দ্ব ও আফ্রিকার জ্যামেতিক মানচিত্রের প্রভাবকে আলোচনা করা হয়েছে।
বইটিতে মোট দশটি অধ্যায় রয়েছে, যেখানে পর্যায়ক্রমে রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত-পাকিস্তান, কোরিয়া-জাপান, লাতিন আমেরিকা, এবং আরকটিক অঞ্চল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সে বিবেচনায় আমরা প্রথমে রাশিয়াকে দিয়ে শুরু করবো। আশাকরি, এই জার্নিতে আপনাদের ধৈর্য ও সমর্থন আমাকে এগিয়ে যেতে সাহস যোগাবে। তাহলে চলুন রাশিয়ার হিমশীতল তুন্দ্রা অঞ্চলে ঘুরে আসা যাক!
ভাবানুবাদক:
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল বই:
Prisoners of Geography: Ten Maps That Explain Everything about the World.
লিখেছেন:
Tim Marshall,
A former foreign correspondent for Britain's Sky News Television
.jpeg)

No comments