Hegemonic Stability Theory: হেজমনের আধিপত্য কি বাস্তবিক না প্রতীকী?
Hegemonic Stability Theory: হেজমনের আধিপত্য কি বাস্তবিক না প্রতীকী?
ইংরেজি শব্দ ‘Hegemon’- এর বাংলা পারিভাষিক অর্থ করা যায়ঃ কর্তৃত্ব, আধিপত্য, নেতৃত্ব, প্রভুত্ব ইত্যাদি; বা সহজ বাংলায় মাতবড়ি বা মোড়লগিড়ি। তবে, বাংলা পারিভাষিক অর্থের তুলনায় ইংরেজি শব্দ/ কনসেপ্ট ‘Hegemon’ ব্যাপক অর্থবহ। সে বিবেচনায় অত্র আলোচনায় আমরা ‘Hegemon’ কে ‘Hegemon’ (হেজমন) হিসেবেই উল্লেখ করবো, এমনকি পরীক্ষাপত্রেও।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিবেচনায়, ‘Hegemon’ তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কিভাবে একটি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অন্যান্য রাষ্ট্রের উপর মোড়লগিড়ি বা মাতবড়ি করে। এছাড়া, কিভাবে হেজমন বা মোড়ল রাষ্ট্রের মোড়লগিরি অন্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে স্থায়ী হবে? সে ব্যাক্ষাও ‘Hegemonic Stability Theory’ বা হেজমনি্ক স্থিতি তত্ত্ব বা কর্তৃত্ব স্থিতিশীল রাখা তত্ত্ব আমাদের প্রদান করে। কেন এবং কিভাবে আধিপত্যশালী রাষ্ট্রের ক্ষমতার স্থিতিশীলতা আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক সিস্টেমকেও স্থিতি দানের জন্য অপরিহার্য এই তত্ত্ব সে ব্যাক্ষাও আমাদের প্রদান করে। এ নিবন্ধে আমরা ‘Hegemon’ স্থিতি তত্ত্বকে পাঠকের কাছে সহজে ও উদাহরণ সমেত উপস্থাপনের চেষ্টা করবো।
হেজমনিক স্থিতি তত্ত্বের মূল কথা হল পৃথিবীতে একটি শক্তিশালী বা একক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রয়োজন (আবশ্যক) যে কিনা আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রয়োজনে একটি মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু করবে। তবে, শুধু চালু করেই ক্ষান্ত হবে না, উপরুন্ত, মুক্ত বাণিজ্যের নানা বিধি-নিষেধও লিপিবদ্ধ করবে এবং সর্বপোরি, সিস্টেমের প্রতিটি অংশ, অর্থাৎ প্রতিটি রাষ্ট্র যেন সে মুক্ত বাণিজ্য বিধি মোতাবেক চলে সে দিকেও নজর দিবে বা রাষ্ট্রগুলোর উপর চাপ বজায় রাখবে।
বৈশিষ্ট্য ও শর্তঃ
কোন রাষ্ট্রকে হেজমন হতে গেলে কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হয়। যথাঃ
(ক) মুক্ত বাণিজ্য বিধিকে বাস্তবায়নে ও অন্যান্য দেশকে চাপে রাখার প্রয়োজনীয় সক্ষমতা হেজমনের থাকতে হবে;
(খ) সক্ষমতা থাকলেই শুধু হবে না, হেজমনকে সে বিধি বাস্তবায়নের প্রতি আগ্রহী ও সংকল্প থাকতে হবে; এবং
(গ) হেজমনের সংকল্প ও আগ্রহের ভিত্তিতে যে সিস্টেম গড়ে উঠবে সেখানে সকল রাষ্ট্রের জন্য, বিশেষত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বৃহৎ দেশগুলোর পারস্পারিক সুবিধা লাভের সুযোগ থাকতে হবে।
তবে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনের ক্ষেত্রেও হেজমনের নিম্নোক্ত তিনটি গুণ থাকতে হবে বা শর্ত পালন করতে হবে।
(১) হেজমনকে হতে হবে উদীয়মান বৃহৎ অর্থনীতির দেশ;
(২) অর্থনীতি ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদানে হেজমনের সক্ষমতা থাকতে হবে; এবং
(৩) হেজমনের বিশাল সামরিক শক্তি থাকবে এবং সে শক্তিকে টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সক্ষমতা ও দক্ষমতা থাকতে হবে।
প্রেক্ষাপটঃ
সময়ের পরিক্রমায় দেখা যায়, প্রযুক্তিগত উতকর্ষ আন্তর্জাতিক সিস্টেমে অসম প্রতিযোগিতাকে উস্কে দেয়। ফলে, আন্তর্জাতিক সিস্টেমে অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও, যদি অর্থনৈতিক, প্রযুক্তি ও অন্যান্যক্ষেত্রে যে (অসম) পরিবর্তন দেখা দেয় তা আন্তর্জাতিক সিস্টেমে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, যা এক পর্যায়ে এসে হেজমনের পজিশনকে দুর্বল করে ফেলে। সে দুর্বল পজিশনের সুযোগে নতুন এক হেজমনের আবির্ভাব ঘটে যে নতুন করে বা পুরাতনকে মার্জিত করে মুক্ত বাণিজ্য নীতি তৈরি করে এবং তা বাস্তবায়নে নজর দেয়।
১৯৭০ ও ১৯৮০’র দশকে আমেরিকান পন্ডিতদের হাত ধরে ‘Hegemon’ স্থিতি তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে। এই পন্ডিতদের অধিকাংশই ছিলেন রিয়েলজিম দর্শনের অনুসারী। তাদের মতে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির স্থিতশীলভাব ও মুক্ত অবস্থা নির্ভর করবে ক্ষমতার বিন্যাসের উপর। তাদের ভাষ্যমতে, একটি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যখন অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে অন্য রাষ্ট্রের চেয়ে অগ্রসর থাকে তখন হেজমন ইচ্ছে করলে নতুন বাণিজ্য ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারে, কারণ তার নিজের রপ্তানির প্রয়োজনেও নতুন নতুন বাজারের দরকার পরে। তাদের ভাষায়, ক্ষুদ্র রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অর্থনীতির উপর যতটা নির্ভরশীল ও আগ্রহী হবে, বৃহৎ শক্তি ততটা হবে না।
মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা ও পাবলিক গুডস
বস্তুত, Hegemon অন্যান্য রাষ্ট্রকে তার প্রবর্তিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় মুক্ত বিচরণের (Free Ride) সুযোগ করে দিবে। অন্যান্য রাষ্ট্র এই সুযোগ ভোগ করবে Hegemon প্রবর্তিত পাবলিক গুডসের (Public Goods) অধীনে। পাবলিক গুডস এমন এক ধরণের জনহিতিকর পণ্য যা সকলেই ভোগ করে থাকে; যার ভোগ থেকে ভোক্তাকে সরিয়ে নেওয়া একবাক্যে অসম্ভব বা দুষ্কর; এবং এই পণ্য একজন ভোগ করলে অন্যের জন্য সেক্ষেত্রে কোন ঘাটতি তৈরি হয় না- সমানভাবেই সকল ভোক্তা ভোগ করতে পারে। হেজমন রাষ্ট্র প্রবর্তিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থায়ও এমন কিছু পাবলিক গুডস থাকবে। যেমনঃ
(ক) মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থাঃ রাষ্ট্র একে অন্যের সাথে বাণিজ্য পরিচালিত করতে পারবে। এক্ষেত্রে বর্তমানে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা পরিচালনের মূল দায়িত্বে আছে যার বৃহৎ অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র।
(খ) সম্পদ ও মেধার স্বত্বাধিকারঃ হেজমন প্রদত্ত ব্যবস্থায় প্রতিটি রাষ্ট্র সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে, বিশেষত তাদের সম্পত্তি ও সম্পদের ক্ষেত্রে স্বত্বাধিকার থাকবে। যেমনঃ তেসলা কম্পানির বা মাইক্রোসফট কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সম্পদ ও পণ্যের স্বত্বাধিকার যেন ঐ প্রতিষ্ঠানেরই থাকে হেজমন প্রদত্ত ব্যবস্থায় তার নিশ্চয়তা থাকবে। এছাড়া, মেধাভিত্তিক বিভিন্ন আবিষ্কার ও প্রভৃতির স্বত্বাধিকারের বিষটিও সে সিস্টেমে প্রাধান্য পাবে।
(গ) সাধারণ আর্থিক ব্যবস্থা। যেমনঃ একটি বা একাধিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা। যুক্তরাষ্ট্র হেজমন হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে সেখানে ইউএস ডলার সাধারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। একই সাথে অন্যান্য বৃহৎ মুদ্রামান এই ডলারের সাপেক্ষে নির্ধারিত হয়েছে। এই সুযোগটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রদত্ত সিস্টেমের অধীনে সকল রাষ্ট্রই ভোগ করে, এমনকি যারা এই সিস্টেমের বিরোধিতা করেছে তারাও ডলারকে একটি পাবলিক গুডস হিসেবে গ্রহণ করেছে।
(ঘ) স্থিতিশীল ও উন্নয়নমূখী সমষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিঃ হেজমন প্রবর্তিত ব্যবস্থায় যে সকল উন্নয়নের নির্দেশণা থাকতে তা হবে উন্নয়নমূখী, স্থিতিশীল ও সমষ্টিক প্রকৃতির। আমরা দেখি রাষ্ট্রের শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জিডিপি, রাষ্ট্রের রিজার্ভ প্রভৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয় যা সমষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির অংশ। এভাবে নতুন বাণিজ্য ব্যবস্থায় সকলে তাদের অভ্যন্তরীণ লক্ষ্যকে সমষ্টিক লক্ষ্যের আঙ্গিকে সাঁজাতে পারে, এবং নিজেদের উন্নয়নকে স্থিতিশীল করতে পারে।
(ঙ) অর্থনৈতিক সঙ্কট সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থাঃ হেজমনের প্রণীত বাণিজ্য ব্যবস্থার একটা বড় অধ্যায় নানাবিদ অর্থনৈতিক সংকট ও সংঘাত সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সংকট সমাধানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হেজমনের পজিশন আরও শক্ত হয়, এবং তার প্রণীত ব্যবস্থার প্রতি অন্যান্য রাষ্ট্রের আগ্রহও বৃদ্ধি পায়।
(চ) নির্দিষ্ট বিনিময় হারঃ হেজমন প্রণীত মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার নির্ধারণ করা। একটি নির্ধিষ্ট বিনিময় হারের অভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয়দের সংকট দেখা দিয়েছিলো যার ফলাফল দ্যা গ্রেট ডিপ্রেশন। এজন্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা হেজমন হিসেবে আসার পর তার প্রণীত বাণিজ্য সিস্টেমের অন্যতম পাবলিক গুডস হিসেবে তার ডলারের মান ধরে আন্তর্জাতিক মুদ্রামান ও বিনিময় হার নির্ধারণ করে। সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্র ডলার থেকে সরে যায় অভ্যন্তরীণ কারণে, এবং স্বর্ণ ও ডলারের মানের ভিত্তিতে নিতুন একটি বিনিময় হার প্রচলন ঘটায়। বর্তমানে রাষ্ট্রগুলো স্বর্ণ ও ডলার ভিত্তিক বিনিময় হার অনুসরণ করছে।
মুক্ত বাণিজ্য ও শক্তি ভারসাম্যঃ
যদি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতি রাষ্ট্র সমানভাবে শক্তিশালী হয় (যদিও তা প্রায় অসম্ভব), তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা তুলনামূলকভাবে হ্রাস পাবে। এ ধরনের ক্ষমতার ভারসাম্যে, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্র সবসময় চাইবে যেকোন রাজনৈতিক সংঘাত থেকে বেঁচে থাকতে। অন্যথায়, সংঘাতে জড়িয়ে সে নিজেকেও অন্য রাষ্ট্রের মত আরও দুর্বল-ভঙ্গুর করে তুলবে। আবার যে রাষ্ট্রটি হেজমন, কিন্তু তার সর্বময় ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করেছে, সে নিজেও তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে সংঘাতে ভয় পাবে বা চিন্তা করবে, কেননা যুদ্ধের ফলে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক খারাপ পরিস্থিতে একধরনের চাপ তৈরি হবে কেননা রাষ্ট্রটি সংঘাতে জড়িয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মাফিক সস্তা মূল্যে খাদ্য আমদানি করতে পিছিয়ে পড়বে।
যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্রে সস্তা চীনা পণ্যের উপর আমেরিকান নাগরিকেরা অনেকাংশে নির্ভর হয়ে পড়েছে, এক্ষেত্রে চীনের সাথে সামরিক বা অন্য যেকোনো দ্বন্দ্ব (যেমনঃ ট্রাম্প বাণিজ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো) আমেরিকার বাজারে চীনা পণ্যের সরবারহ কমিয়ে দিবে, যা সাধারণ আমেরিকানদের জন্যই নেতিবাচক। যদিও, ট্রাম্পের আগমনে আমেরিকার স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ঘটতে পারে যা সস্তা পণ্যের সুযোগকে আমেরিকানদের জন্য সীমিত করে তুলবে।
তবে, তাত্ত্বিকভাবে হেজমন স্থিতি তত্ত্বকে যতই সহজ ও প্রয়োগযোগ্য মনে হোক না কেন, বস্তুত, এ তত্ত্বটি এখনো নিজেকে সেভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এ তত্ত্বের ক্ষেত্রে সমালোচকরা বলে থাকেন যে আদতেই কি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় কোন হেজমনের প্রয়োজন রয়েছে। অন্যদিকে, হেজমন স্থিতি তত্ত্বের প্রবক্তারা প্রধানত তিনটি উদাহরণকে বা রাষ্ট্র/ সাম্রাজ্যকে হেজমন হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। যথাঃ সপ্তদশ শতকের ডাচ বা নেদারল্যান্ডকে, উনবিংশ শতকের শেষের দিকে বৃটেনকে, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে।
সমালোচনাঃ
মাত্র তিনটি উদাহরণের সাপেক্ষে একটি তত্ত্বকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পক্ষে অনেক বিশেষজ্ঞ নয়, তাই এই তত্ত্বকে ঘিরে সমালোচনাও রয়েছে প্রচুর। এক্ষেত্রে হেজমন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে সমালোচকদের প্রধানত দুইটি প্রশ্ন রয়েছে। যথাঃ
১। ১৯৩০ এর দশকে যখন গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দা চলছে, তখন অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ ছিলো যুক্তরাষ্ট্র । কিন্তু, মহামন্দার প্রভাব কমিয়ে আনার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করতে কিছুই করেনি। অথচ, এ মহামন্দার প্রভাব কমিয়ে আনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজের ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কল্যাণে কাজ করতে পারতো, এর দরুন উভয়েরই মুনাফা হতো।
২। যুক্তরাষ্ট্রের হেজমন পজিশন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামরিক সক্ষমতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থার হেজমন হয়েছিলো, সামরিক শক্তি ঠিক থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সে তুলনায় হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে ১৯৬০ এর দশকে যখন জার্মানি ও জাপান অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের একক অর্থনৈতিক আধিপত্যে লাগাম টানতে শুরু করে। তাহলে, কিভাবে মাত্র ২৭ বছরের (১৯৪৪-৭১) অর্থনৈতিক আধিপত্য যুক্তরাষ্ট্রকে হেজমন করে তুলতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণটি কী এই তত্ত্বের অন্তঃসার শূন্যের পক্ষে যথেষ্ট প্রমান দেয় না?
হেজমন স্থিতি তত্ত্বের বিপরীতে আরও একটি বড় সমালোচনা হল এ তত্ত্বে আলাদাভাবে কোন বৈশিষ্ট্য বা শর্তের উল্লেখ নেই যেগুলো কোন রাষ্ট্রের হেজমন ক্ষমতার স্থিতিশীলতা মূল্যায়নে দরকার পড়বে। গত শতকে, যখন জাপানের অর্থনৈতিক সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে তেমন একটি প্রেক্ষাপট ঘিরে হেজমন স্থিতি তত্ত্বের সূচনা ঘটে। আবার একইভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, স্নায়ু যুদ্ধের অবসান এবং দীর্ঘ মন্দায় জাপানি অর্থনীতিতে ধ্বস প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সিস্টেমকে দারুনভাবে প্রভাবিত করে। এই ঘটনাগুলো একইভাবে হেজমন স্থিতি তত্ত্বকে পুনঃমূল্যায়নের দাবী তোলেঃ আসলেই কী যুক্তরাষ্ট্রের হেজমন ক্ষমতার ইতি ঘটেছ?
বিংশ শতকে জাপানের অবস্থান একবিংশ শতকে চীনের দখলে। চীনের উত্থানকে ঘিরে হেজমন স্থিতি তত্ত্ব তার ভবিষ্যৎ (সম্ভাব্য) হেজমন চীনকে গুরুত্ব দিচ্ছে, এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের হেজমনি শক্তির কী ইতি ঘটলো? চীন কি তবে নতুন হেজমন হয়ে উঠবে? চীনের দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সিস্টেম কেমন হবে? প্রভৃতি।
হেজমন নিয়ে উদারবাদীদের ভাবনাঃ
এছাড়াও, হেজমন স্থিতি তত্ত্ব নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। এই নতুন বিতর্কগুলো হেজমন স্থিতি নিয়ে চলমান বিতর্কগুলোকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। হেজমন স্থিতি তত্ত্ব সাধারণ ভাষায় আন্তর্জাতিক সিস্টেমের ক্ষমতার কাঠামোর ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ফলাফল বিশ্লেষণ করে। তবে, উদারবাদীদের দৃষ্টিতে এটি খুব সরল ব্যাক্ষা যা গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যকার সম্পর্কটি জটিল। উদারবাদীদের ভাষায়, এই জটিলতায় সবচেয়ে উপযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান/ সংস্থা ও তাদের প্রণীত নানা আইন-কানুন। এই প্রতিষ্ঠান তার প্রণীত আইনের সঠিক প্রয়োগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্র প্রসারিত করতে পারে।
উদারবাদীদের দাবী, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার পরিবর্তন ও নয়া হেজমনের আবির্ভাবেও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রায়োগিক সক্ষমতা ও নিরপেক্ষ ভূমিকাতে কোন পরিবর্তন আসবে না। উপরুন্তু, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ভূমিকা সকল দেশকেই মুক্ত বিশ্ব বাণিজ্যের দিকে ধাবিত করবে। সকল রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একত্রে কাজ করবে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে, কারণ এতে তাদের সকলের মুনাফা রয়েছে।
যেমনঃ বর্তমানে আমেরিকার সাথে চীনের যতই সংঘাত বা সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি হোক না কেন, চীন যদিও নতুন মুদ্রাব্যবস্থার কথা বলে, তবুও চীন বিশ্ব বাণিজ্য (WTO) সংস্থার নিয়ম মেনে চলতে চায় (যদিও চীনের WTO- এর নিয়ম মানা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে)। কারণ, ড্যাং ঝিয়াওপিং- এর চীনা সংস্কার নীতিতে WTO প্রণীত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে অনুসরণ করে চীনের অর্থনীতিকে গড়ার কথা বলা হয়েছে, এবং চীনের এই অর্থনৈতিক মিরাকেল যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অনুসরণেই সম্ভব হয়েছে।
তবে, বর্তমানে হেজমন স্থিতিশীল তত্ত্ব নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র অনেক কমে এসেছে। এর একটি কারণ এই তত্ত্বকে সেভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। সেভাবে বিশদভাবে ব্যাক্ষা করে পাঠক মহলে উপস্থাপনের চেষ্টা হয় নি। এখন কোন একটি সিস্টেমের বা হেজমনের দিকে রাষ্ট্র তাকিয়ে থাকতে চায় না, এখন তারা নিজেদের প্রয়োজনে আঞ্চলিকার ধারণা তৈরি করেছে, বিশেষত আসিয়ান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সফল হওয়ার পর। ফলে, হোক সে ক্ষমতাধর বা দুর্বল দেশ সকলেই একপাক্ষিক মূনাফার তুলনায় পারস্পারিক মূনাফাকে বেশি প্রাধান্য দিতে চাচ্ছে।
তাই, সহযোগিতার বিষয়টি নতুন করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যার অস্থিত্ব হেজমন স্থিতিশীল তত্ত্বে সেভাবে নেই। কারণ, হেজমন যদি সহযোগিতাকেই প্রাধান্য দেয় তাহলে তাকে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এবং যদি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হয় তখন কোন দেশেরই হেজমন থেকে অর্থনৈতিক সুরক্ষার প্রয়োজন পড়বে না।
ভাবানুবাদকঃ
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল বই:
International Relations: The Key Concepts
By- Martin Griffith, Tarry O'Callaghan & Steven C. Roach
International Relations: The Key Concepts
By- Martin Griffith, Tarry O'Callaghan & Steven C. Roach


No comments