ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিবাসন
![]()  | 
| Jewish Migration to Palestine | 
ইহুদিদের ইতিহাসে ‘অভিবাসন’ প্রত্যয়টি আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে। ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে ফের-আউনের অত্যাচার হতে বাঁচতে, হযরত মুসা আঃ-এর নেতৃত্বে মিশরের সিনাই উপত্যকা হয়ে প্রাচীন ফিলিস্তিন (জুডাহ ও সামেরি) অঞ্চলে ইহুদিদের অভিবাসন শুরু হয়। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের আক্রমনে যখন আলেক্সান্দ্রিয়া কেন্দ্রিক হেলেনিক সভ্যতার বিনাশ ঘটে, তখন অবশিষ্ট ইহুদিরা মিশর ছেড়ে আরব ভূখন্ড ও ইউরেশিয়া অঞ্চলে অভিবাসন করে।
ইহুদিরা
ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে নিজেদের সবচেয়ে নিগৃহীত,নির্বাসিত, ও নিপীড়িত অভিবাসী বলে দাবী
করে। তাদের ভাষায় ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে বর্তমান ফিলিস্তিন ভূখন্ড যা অতীতে সুমেরি
ও জুডাহের অংশ ছিলো তা ঐশ্বরিকভাবে ইহুদিদের আবাসস্থল বা হোমল্যান্ড। 
তবে,
ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইহুদিদের শান্তিপূর্ণ বসবাস বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।  খ্রিষ্টান চার্চ ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঈসা আঃ-কে ক্রুশবিদ্ধ
করে হত্যার অভিযোগ আনয়ন করে। ফলে, রোমান সাম্রাজ্য যখন ফিলিস্তিন দখল করে, রোমানরা
ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যপক হত্যাযজ্ঞ চালায়- যা থেকে বাঁচতে আরব ভূখন্ডের অধিকাংশ ইহুদিরা
ইউরোপের দিকে পালিয়ে যায়। এই পালিয়ে যাওয়ার বা বিতারিত হওয়ার ঘটনাকে ইংরেজিতে
Exodus বলে। 
সময়
অতিবাহিত হয়ে চলে, ইহুদিরা ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তারা ইউরোপীয়ান সমাজের সাথে
মিশে যেতে থাকে। তবে প্রথম ক্রুসেড পরবর্তী সময় থেকে ইউরোপেও ইহুদি অভিবাসন কঠিন হয়ে ওঠে । ১২ শতকের শুরু দিকে, ক্রুসুডারদের নেতৃত্বদানকারী দেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্স
থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়। ফলে তারা রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে পালিয়ে অভিবাসন করেন।
তবে ঐ সময়, তাদের সামান্য কিছু ইহুদি ফিলিস্তিনে ফিরে যান। 
১৪৯২
সালে, তৎকালীন সর্ববৃহৎ ইউরোপীয় শক্তি স্পেনীয় সাম্রাজ্য ক্যাথলিক ধর্মকে স্পেনের রাষ্ট্রধর্ম
হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে, পুনরায়, ইহুদিদের যিশু খ্রিস্টের হত্যাকারীর তকমা দিয়ে স্পেন
থেকে বিতাড়িত করে। তখন বেশিরভাগ ইহুদি জার্মানিতে পালিয়ে গেলেও, কিছু সংখ্যক ইহুদি অটোম্যান সাম্রাজ্যভুক্ত ফিলিস্তিনে আশ্রয় গ্রহণ করে। 
অষ্টাদশ
ও উনবিংশ শতকে ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষ মনোভাব বাড়তে থাকে। ফলে, ধর্মীয় কারণে নিপীড়ন থেকে
বাঁচতে বিংশ শতকের প্রথম থেকেই ইউরোপ ছেড়ে অধিক সংখ্যক ইহুদি ফিলিস্তিনে অভিবাসন শুরু
করে। রাশিয়া ও পোলান্ডের পশ্চিম সীমান্তে ইহুদিরা ক্ষনস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তবে,
১৮৮১ সালে, রাশিয়ান জারের হাতে ইহুদিরা আরও একবার গণহত্যার শিকার হন। এই গণহত্যা থেকে
বাঁচতে কিছু ইহুদি রাশিয়ার একদম পূর্বদিকে পালিয়ে যায়, বাকিরা ফিলিস্তিনের দিকে  যাত্রা করে।
রাশিয়ার পর ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষ ব্যাপক আকার ধারন করে। এই ইহুদি বিদ্বেষকে ইহুদিরা Anti-Semitism বলে পরবর্তীতে প্রচার করে। উল্লেখ্য, Anti-Semitism দ্বারা শুধু ইহুদিদের নয়, বরং আরবীয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিককে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
রাশিয়ার পর জার্মানি, অস্ট্রো-হাংগেরি এবং ফ্রান্স
ইহুদিদের প্রতি কঠোর আচারণ শুরু করে। ১৮৯৪ সালে, আলফ্রেড দ্রাইফুজ নামে এক ফরাসি সেনা
কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আরোপ আনা হয়। 
দ্রাইফুজ
একজন ইহুদি ছিলেন। ষড়যন্ত্রের দায়ে তাকে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়, তবে বিচার বিভাগ
তদন্ত সাপেক্ষে দ্রাইফুজকে নিরাপরাধ ঘোষণা করে। তবে, ততদিনে যা হবার তা হয়ে গেছে। কিছু
উগ্রবাদী ডানপন্থি দল, ইহুদিদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন প্রচার
প্রচারণা শুরু করে। ফলে, ইউরোপ জুড়ে, এন্টি-সেমেটিক আন্দোলনের মাত্রা চরমে গিয়ে পৌঁছে।
দ্রাইফুজেরর ঘটনাটি থিওডর হার্জলকে নাড়া দেয়। তিনি ছিলেন একজন অস্ট্রিয়ান ইহুদি সাংবাদিক। দ্রাফুজের ঘটনার ব্যাক্ষায় হার্জেল বলেন কেবল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ইহুদি রাষ্ট্রই পারে ইহুদিদের সকল ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে রক্ষা করতে।
সে বিবেচনায় হার্জেল প্রথম জায়নবাদী
কংগ্রেস সম্মেলনের আয়োজন করেন- যা জায়নবাদী আন্দোলনের সূচনা বিন্দু। জায়নবাদী আন্দোলনের
মূল কথা, একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ইহুদিদের Anti-Semitism তকমা ও সামগ্রিক
নিপীড়ন থেকে বাঁচাতে পারে। আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্র এই জায়নবাদী আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত
হয়েছে। 
১৯৩০-এর দশকে নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের উত্থান ইউরোপজুড়ে ইহুদি বিদ্বেষকে চূড়ান্ত রূপ দান করে। এই অজুহাতে, হিটলার ইতিহাস ঘৃণিত ইহুদি গণহত্যা সংগঠিত করেন। ফলে, অস্তিত্ব রক্ষায় জার্মান ও পোলান্ডে থাকা অবশিষ্ট ইহুদিদের কিছু অংশ আমেরিকায় ও বাকীরা ফিলিস্তিনে অভিবাসন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিরূপ প্রেক্ষাপটে নানান প্রতিকূলতা পেড়িয়ে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে
বসবাসরত ইহুদিদের সাথে মিলিত হয়। এবং ক্রমান্বয়ে, হার্জেলের জায়নবাদী ধারণা অর্থাৎ, ইহুদিদের
কাছে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আবশ্যক হয়ে ওঠে, এবং ১৯৪৮ সালে তারা ইসরায়েল
নামে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন যার প্রতিক্রিয়া এখনও চলমান।  
(সংক্ষেপিত)
ইহুদিদের বিতাড়িত হওয়ার সময়কালঃ
-  আনুমানিক ১৩১২ খ্রিষ্টঃ পূর্বে মুসা আঃ মিশর থেকে হিজরত করে;
 -  আনুমানিক ৫৮০ খ্রিষ্টঃ পূর্বে ব্যবলনীয় রাজা নেবুচাদ নেজার ফিলিস্তিন দখল কর সুলাইমান আঃ-এর রাজপ্রাসাদ ধ্বংস করে ইহুদিদের বিতাড়িত করে;
 -  আনুমানিক ৬৩ খ্রিষ্টঃ পূর্বে ফিলিস্তিন প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়;
 -  আনুমানিক ৬৬-৭০ খ্রিষ্টাব্দে, প্রথম ইহুদি ও রোমান যুদ্ধ সংগঠিত হয়, যে সময় প্রায় লক্ষাধিক ইহুদিকে হত্যা করা হয় এবং সমপরিমাণে তাদের দাস হিসেবে বন্দী করা হয়;
 -  ৭৩-৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মের মাঝে বিবাহ ও ধর্মান্তর হওয়া আইন প্রণয়ন করে নিষিদ্ধ করেন;
 -  ১৩০৪-১৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দে, ইহুদিদের ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত করা হয়, এবং পোলান্ডের রাজা কাসিমির দ্যা গ্রেট ইহুদিদের আশ্রয় দেন;
 -  ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দ আলহাম্ব্রা আইন জারি করে প্রায় দুই লক্ষ ইহুদিকে স্পেন থেকে বিতাড়িত করা হয়, এবং অটোমান সম্রাট বায়জিদ, বিতাড়িত ইহুদিদের অটোমান সাম্রাজ্যে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান;
 -  ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দে ভেনেশিয়ান ঘেটো বা বস্তি নামে ইউরোপে প্রথম ইহুদি ঘেটো বা বস্তি তৈরি করা হয়;
 -  ১৭৭৫-৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকান বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লব ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ইহুদিদের নাগরিকত্ব প্রদান করে;
 -  ১৮৮১-১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়া ও ইউক্রেনে প্রায় দশ হাজার ইহুদিকে হত্যা করা হয়, এবং এই সময়ে প্রায় ২০ লক্ষ ইহুদি রাশিয়া ছেড়ে অন্যত্র পলায়ন করে। এটাকে প্রথম Aliyah বলে।
 -  ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে কয়েক হাজার ইহুদি মারা যায়;
 -  ১৯৩৩-৪৫ খ্রিষ্টাব্দে হিটলার ইহুদি নিধন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে। প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়; প্রভৃতি।
 
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়
 
 
 
1. ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিবাসন:
2. যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে ইসরায়েল লবি'র প্রভাব
3. BDS আন্দোলন: পশ্চিমে- ইসরায়েলের অবস্থান কাঁপিয়ে দিয়েছিলো যে মুভমেন্ট
4. দ্যা নাকবা (Nakba): ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ফিলিস্তিনি বিপর্যয়


No comments