Header Ads

Header ADS

আন্-নাকবা (An-Nakba): ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ফিলিস্তিন বিপর্যয়


Nakba (The Catastrophe)

তারা (ইসরায়েলি সৈন্যরা) আমাদের একজায়গায় একত্র করে এক বৃদ্ধকে গুলি করে হত্যা করে। যখন বৃদ্ধের মেয়েদের একজন চিৎকার করে ওঠে, তখন তাকেও গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। তারা আমার ভাই মোহাম্মাদকে লাইনে দাড় করায় এবং আমাদের সম্মুখে তাকে গুলি করে হত্যা করে, আমার মা যখন ভাইয়ের মৃত্যুতে আর্তনাদ করে ওঠে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়, মায়ের কোলে থাকা আমার ছোট দুধ-বোনকেও তারা গুলি করে হত্যা করে।” 


Nakba (Arabic: النكبة an-Nakba) আরবি ভাষা হতে নাকবা প্রত্যয়টি উদ্ভূত। নাকবা শব্দটির আবিধানিক অর্থ বিপর্যয় বা চরম দুর্দশা, যাকে ইংরেজিতে Catastrophe বলে। ১৯৪৮ সালে, ফিলিস্তিন ভূখন্ডে ইহুদি রাষ্ট্র (ইসরায়েল) প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে ইহুদি জায়নবাদীরা, সংহিসতা ও জোরপূর্বক অসংখ্য স্থানীয় আরব ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখন্ড ছাড়তে বাধ্য করে। সেই প্রেক্ষাপট বুঝাতে পরবর্তীতে নাকবা শব্দটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত হয়ে ওঠে। 

শুধু নিজ ঘর থেকেই ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করা হয়নি, পাশাপাশি তাদের শত শত বছরের গড়ে ওঠা সমাজ, সাংস্কৃতি, ঐতিহ্য, স্বতন্ত্র পরিচিতি, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রভৃতিকেও ক্রমান্ময়ে ধ্বংস করেছে বা করছে ইসরায়েল। সাম্প্রতিক ইসরায়েলে হামাসের আক্রমনে যে হাজারো ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন তার প্রতিক্রিয়া বা প্রতিশোধ হিসেবে ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। 

প্রায় বিশ হাজারেরও বেশি নিরীহ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের বোমা হামলা ও সামরিক আক্রমনে নিহত হয়েছেন যার অধিকাংশই শিশু ও নারী। তাই, ১৯৪৮ সালে শুরু হলেও, ফিলিস্তিন বিপর্যয় বা Nakba এখনও চলমান রয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা ফিলিস্তিন নাকবা’র ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করবো। 


সূচনাঃ অটোম্যান ফিলিস্তিন ও ব্রিটিশ দ্বিচারিতা:


দ্বিতীয় ক্রসেডে মুসলীম বীর সালাহ-উদ্দিন আইয়্যুবি জেরুজালেম ভূখন্ডকে সেলজুক সাম্রাজ্যের অংশ করেন। অটোম্যান শক্তির কাছে সেলজুকদের পরাজয়ে পরবর্তীতে জেরুজালেম অটোম্যান বা উসমানীয় খেলাফতের অংশ হয় যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যানদের পরাজয়ের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের হস্তগত হয়।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে, ১৯১৬ সালে, ফ্রান্স ও বৃটেনের দুই  কূটনৈতিক গোপনে ভবিষ্যৎ মধ্যপ্রাচ্যের রূপরেখা হিসেবে সাইকস-পিকো চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির ফলে লেভান্ত অঞ্চল চলে যায় ফ্রান্স সাম্রাজ্যের দখলে, এবং ইরাক, মিশর ও (জেরুজালেমসহ) আরবীয় উপদ্বীপ চলে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে। 


পরবর্তীতে, জেরুজালেমকে নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের নীতিগত দ্বিচারিতা লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ, জেরুজালেম দখলের পর প্রথমে ব্রিটিশ সরকার, ১৯১৭ সালে, বেলফোর ঘোষণা করে। এই ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ফিলিস্তিন ভূখন্ডে ইহুদিদের দাবীর ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়া। 


ফিলিস্তিন আরবরা যখন এই ঘোষণার বিরোধীতা শুরু করে, তখন ব্রিটিশ সরকার  ফিলিস্তিন আরবদের আন্দোলন প্রশমনে পরবর্তী দশ বছরের জন্য ফিলিস্তিনিদের জেরুজালেমে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়। ঐ সময় ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা ছিলো প্রায় ৮ লক্ষ, যার মধ্যে প্রায় ৭৩০,০০০ জন ছিলেন ফিলিস্তিন আরব (৬৫০,০০০ জন মুসলিম আরব, ৮০,০০০ জন খ্রিস্টান আরব), এবং ৬০,০০০ জন ছিলেন ইহুদি। 


জায়নবাদী প্রকল্পঃ বর্ণবাদ ও জাতিগত নির্মূল


উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে  ইউরোপে জায়নবাদী মুভমেন্ট শুরু হয়। ইহুদি ধর্ম, ইউরোপীয় সামরিক শক্তি, ও ইহুদি ধর্ম কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনার সমন্বয়ে জায়নবাদী মুভমেন্টের সূচনা ঘটে। এই মুভমেন্টের লক্ষ ছিলো ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এভাবে এক ভূখন্ডকে নিয়ে দুই জনসংখ্যার বিভেদ, বিরোধ ও সংঘাত শুরু হয়। একদল হল ফিলিস্তিনি, যারা শতশত বছর ধরে এই ভূখন্ডের অধিবাসী। অন্যদল ইহুদি জায়নবাদী, যাদের ভাষায়, জেরুজালেম তাদের ইশ্বর প্রদত্ত ভূমি (Promised Land) এবং ফিলিস্তিনিরা এখানে জোর করে ও অবৈধভাবে বসবাস করছে, যাদের অবশ্যয়ই জেরুজালেম ছাড়তে হবে।  


এবাদেও, জায়নবাদীরা জেরুজালেমকে শুধুই ইহুদিদের ভূখন্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, অর্থাৎ, ফিলিস্তিনি আরব মুসলমান ও আরব খ্রিস্টানমুক্ত জেরুজালেম গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য। ইসরায়েলের এহেন আচারণ আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে বর্ণবাদ হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পর ইসরায়েলকে একটা বর্ণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। 


যাহোক, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে জায়নবাদীরা এটা বুঝতে পারছিলো যে ফিলিস্তিনে স্থানীয়  আরবদের সংখ্যা তাদের (অভিবাসী ইহুদিদের) তুলনায় অনেক বেশি। তাই (জোরপূর্বক) ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র পথ হল: শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের জেরুজালেম হতে বিতাড়িত করা, এবং সহিংসভাবে, দরকার হলে হত্যা বা গণহত্যা চালিয়ে স্থানীয়দের ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ছাড়তে বাধ্য করা। এই পদ্ধতিকে আন্তর্জাতিক অপরাধের ভাষায় জাতিগত নির্মূল (Ethnic Cleansing) বলা হয়। 


ব্রিটিশ মেন্ডেট ও জেরুজালেমঃ 


প্রথমে লীগ অব নেশনস এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘের অছি পরিষদের সুপারিশে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিন ম্যান্ডেট গ্রহণ করে। ম্যান্ডেট বলতে বুঝায় কোন কাজের বৈধ আদেশ। ম্যান্ডেটের অধীনে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিন ভূখন্ড শাসনের আইনত অধিকার পায়। এই সময় অন্যান্য আরব ভূখন্ডের তুলনায় ফিলিস্তিনে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনেক অগ্রগতি হয়। ফিলিস্তিনের কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতি ক্রমশ বাড়তে থাকে, এবং আমদানির তুলনায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ফিলিস্তিনের রপ্তানির পরিমাণ অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। 


ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধারাবাহিক রাখতে ব্রিটেন প্রথমে স্থানীয় আরব ফিলিস্তিনিদের সাথে আগত ইহুদি অভিবাসীদের এক মেল বন্ধন তৈরির চেষ্টা করেন। কিন্তু জায়নবাদীদের তীব্র আন্দোলন ও ব্রিটিশ সরকারের কিছু উচ্চ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জেরুজালেমকে শুধু ইহুদিদের জন্যই রাষ্ট্র করার সমর্থন দেয়, উভয় জনগোষ্ঠীর মাঝে সমন্বয়ের সম্ভাবনায় ইতি টানে।


ফলে নতুন ম্যান্ডেটের অধীনে ব্রিটেন অধিক সংখ্যক ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। নতুন অভিবাসী ইহুদিরা যখন ফিলিস্তিন ভূখন্ড অধিক মাত্রায় অবৈধ দখল শুরু করে, তখন আরবদের ভিতরে অভিবাসী ইহুদিদের নিয়ে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়। ফলে স্থানীয় আরবদের সাথে অভিবাসী ইহুদিদের সংঘাতের সুত্রপাত ঘটে। 


১৯৩৬ সালে সংঘাতের মাত্রা চরমে পৌঁছালে ব্রিটিশ সরকার শক্ত হাতে তা দমন করে। বিভক্তি সীমারেখা নির্ধারণ বাদে আরব-ইহুদি সঙ্কট সমাধানের যে অন্য কোন পথ খোলা নেই তা ব্রিটেনের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলস্বরূপ, ১৯৩৯ সালে ব্রিটেন ঘোষণা দেয় যে ব্রিটেন বেলফোর ঘোষণা প্রত্যাহার করবে, এবং আরব ভূখন্ডে ইহুদি অভিবাসন ও ভূমি ক্রয়ের সহজ সুযোগ পূর্বের তুলনায় কমিয়ে দেবে। জায়নবাদী ইহুদিরা ব্রিটেনের এই ঘোষণার বিরোধিতা শুরু করে, এবং তারা ফিলিস্তিন আরব ও সেখানে থাকা ব্রিটিশ সেনাদের উপরে সহিংস আক্রমণ শুরু করে। 


এছাড়াও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ফিলিস্তিন ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ব্রিটেনের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় জার্মান আক্রমন প্রতিহত করতে যে ধরনের সমরাস্ত্রের প্রয়োজন, তার সংরক্ষণের কেন্দ্র ছিলো ফিলিস্তিন। ফলে, ২য় বিশ্বযুদ্ধকালে ফিলিস্তিনের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট ব্রিটেনের কাছে ততটা গুরুত্ব পায়নি। 


যুদ্ধ যখন শেষ হয়, তখন ব্রিটিশ তার মধ্যপ্রাচ্য ম্যান্ডেটের জেরুজালেম অংশ জাতিসংঘের নিকট হস্তান্তর করে। কিন্তু দু:খজনকভাবে, জাতিসংঘ জেরুজালেম সঙ্কট সমাধানে এক বিতর্কিত ও অসম রেজুলেশন নিরাপত্তা পরিষদে পাশ করে। রেজুলেশন অনুযায়ী ফিলিস্তিনকে স্থানীয় আরব ফিলিস্তিনি ও ইহুদিদের মাঝে ভাগ করা হবে, যা পরবর্তীতে জাতিসংঘের বিখ্যাত সীমারেখা প্রস্তাব বা UN Partition Plan নামে পরিচিতি পায়।


জাতিসংঘের রেজুলেশনটিকে অসম ও বিতর্কিত বলার কারণ সীমারেখা প্রস্তাবে স্থানীয় জনসংখ্যার অনুপাতকে প্রাধান্য না দিয়ে, একধরণে ইহুদিদের পক্ষেই সীমা নির্ধারনী প্রস্তাব দেওয়া হয়। অর্থাৎ, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা ছিলো প্রায় ১,৭৫০,০০০ জন, যার ৩১ শতাংশ (৫৪২,৫০০ জ্ন) ছিলো ইহুদি। ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মাত্র ৬ শতাংশ ভূখন্ড ক্রয়সূত্রে মালিক ছিলেন।


কিন্তু, রেজুলেশনে মোট ফিলিস্তিন ভূখন্ডের প্রায় ৫৫ শতাংশ ইহুদিদের, এবং স্থানীয় ও এত বিশাল জনসংখ্যা হওয়া সত্বেও মাত্র ৪৫ শতাংশ ভূখন্ড আরব ফিলিস্তিনিদের (মুসলিম ও খ্রিষ্টান) দেওয়া হয়। ফলে, এই রেজুলেশন, সঙ্কট সমাধানের বদলে ফিলিস্তিনি ও ইহুদি সংঘাতকে একটা স্থায়ী রূপ দান করে।  


ইসরায়েল রাষ্ট্রের সূচনাঃ 


জায়নবাদী ইহুদিরা জাতিসংঘের Partition Plan কে স্বাগত জানায়, এবং এই রেজুলেশনের বর্ণিত অংশ দখলের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্র এই রেজুলেশনকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘের এ ধরনের রেজুলেশন পাশ করার পূর্বে অবশ্যয়ই ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের সাথে পরামর্শের আবশ্যক ছিলো। ফলে, এই রেজুলেশনটি আন্তর্জাতিক আইনগত বৈধতা হারায়।  


১৯৪৭-এর শেষের দিকে কোনরূপ সমাধান ছাড়াই ব্রিটিশরা জেরুজালেম ছেড়ে চলে যায়। এই সুযোগটা ইসরায়েল গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালে, ইসরায়েল একটি সুক্ষ্ম পরিকল্পনা করে যা প্লান ডি (Plan- D) নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া নানান গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ও সমরাস্ত্র দখল করা, এবং এই অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বেশি সংখ্যক ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি ছাড়তে বাধ্য করা, ফিলিস্তিনিদের ফেলে যাওয়া জায়গার যাবতীয় স্থাপনা ধ্বংস করা, বিশেষত শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো দখলে নেওয়া। 


ইসরায়েলের প্লান ডি- এর শিরোনাম ছিলো ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূল করা। প্লান ডি-এর সারসংক্ষেপ এভাবে করা হয়,


ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিম্নোক্ত নিয়মটি মেনে চলবে: 


১. ফিলিস্তিনের যে সকল গ্রাম বা জনগোষ্ঠীরা সামরিকভাবে শক্তিশালী, তাদের গ্রাম বা জনপদ ধ্বংস করতে হবে। সেক্ষেত্রে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী হয় আগুন জ্বালিয়ে দিবে বা বোমা হামলায় সব গুড়িয়ে দিবে, অথবা তাদের (ফিলিস্তিনিদের) জরুরি স্থাপনা ও পথগুলোয় মাইন বোমা স্থাপন করবে; 


২. অথবা সামরিক অপারেশন চালানোর ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত নির্দেশনা অনুসরণ করবে: তাদের গ্রামগুলোকে ঘেরাও করে তল্লাশি চালিয়ে যাবে। যদি সেক্ষেত্রে কোন বাধা আসে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও শক্তি প্রয়োগ করবে এবং সেই জনপদের অধিবাসীদের ফিলিস্তিনের সীমানা ছাড়া করবে। 


এই পরিকল্পনাকে সামনে রেখে ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে, ইসরায়েল নিজেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। ঘোষণার পরবর্তী দিন (১৫ মে, ১৯৪৮) যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, এবং ১৭ মে, ১৯৪৮ তারিখে সোভিয়েত ইউনিয়নও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। কোন রূপ রাষ্ট্রীয় সীমারেখা না থাকলেও, এবং অবৈধ দখলদারিত্ব ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চলমান থাকা সত্বেও, ১৯৪৯ সালের মে মাসে ইসরায়েল জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। 

    


 দ্যা নাকবা (ফিলিস্তিনি বিপর্যয়):


১৯৪৬ সাল পরবর্তী সময় থেকে যখন জায়নবাদীরা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাস শুরু করে, তখন থেকে জায়নবাদীরা সামরিক প্রয়োজনে ফিলিস্তিনের প্রতিটি গ্রাম ও উপশহর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করতে শুরু করে।  জায়নবাদীদের হাতে যখন যথেষ্ট তথ্য চলে আসে তার কয়েকমাস বাদেই জাতিসংঘ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড আলাদা করার রেজুলেশন পাশ করে।


Partition Plan পাশ হওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় ইহুদি সামরিক ইউনিট ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রথম মাসের মাথায় জায়নবাদী সামরিক শক্তি ফিলিস্তিনের একটা গ্রামকে গুড়িয়ে দেয়। জায়নবাদীদের সহিংসতা এতটাই চরমে পৌঁছে যে প্রায় ৭০ হাজার ফিলিস্তিন আরব গ্রামটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রথম অপারেশনে সফল হওয়ায়, জায়নবাদীরা তাদের সকল সামরিক শক্তি এই কাজে ব্যবহার করে, এবং ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে জায়নবাদীদের প্লান-ডি পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়। 


আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়  ফিলিস্তিনে এরূপ নজিরবিহীন ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের জনহ ইসরায়েলকে ধিক্কার জানায়। ০৯ এপ্রিল, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাথে কুখ্যাত স্টেয়ার্ন গ্যাং ও ইরগুন ইউনিট এই ধ্বংসযজ্ঞে যোগ দেয়। 


তারা দায়ের ইয়াসিন নামে গ্রামে প্রবেশ করে নির্বিচারে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর গুলি চালিয়ে অনেককে হত্যা করে। গ্রামে যারা বেঁচে ছিলো তাদেরকে বন্দি করা হয়, এবং পরবর্তীতে নির্দয়ভাবে তাদের হত্যা করা হয়, যার মধ্যে প্রায় ত্রিশের অধিক ছিলো শিশু। দায়ের ইয়াসিন গ্রামের প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনি অধিবাসীকে হত্যা করা হয় এবং গ্রামটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনিদের সামনে দায়ের ইয়াসিন গ্রামকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে ফিলিস্তিনিদের অতিসত্বর জেরুজালেম ছাড়ার নির্দেশ দেয়। 


১২ বছর বয়সী এক প্রত্যক্ষদর্শী দায়ের ইয়াসিন গ্রামের গণহত্যার বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন,


তারা (ইসরায়েলি সৈন্যরা) আমাদের একজায়গায় একত্র করে এক বৃদ্ধকে গুলি করে হত্যা করে। যখন বৃদ্ধের মেয়েদের একজন চিৎকার করে ওঠে, তখন তাকেও গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। তারা আমার ভাই মোহাম্মাদকে লাইনে দাড় করায় এবং আমাদের সম্মুখে তাকে গুলি করে হত্যা করে, আমার মা যখন ভাইয়ের মৃত্যুতে আর্তনাদ করে ওঠে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়, মায়ের কোলে থাকা আমার ছোট দুধ-বোনকেও তারা গুলি করে হত্যা করে।” 

   

ইসরায়েল সেনাবাহিনী অন্যান্য গ্রামের অধিবাসীদের দ্রুত গ্রাম ছেড়ে পালানোর সুযোগ দেয়, তবে কোন ধরণের সম্পদ নিয়ে ফিলিস্তিনিরা গ্রাম ছেড়ে পালাতে পারবে না। যখন তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়, বোমা হামলা চালিয়ে গ্রামগুলোকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। পাশাপাশি ইরগুন সন্ত্রাসীগোষ্টী হত্যাযজ্ঞ চলমান রাখে। যেমনঃ ইরগুন গোষ্ঠী, ২২ মে, ১৯৪৮ সালে তান্তুরা নামের একটা গ্রামের প্রায় ৩০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। 

  

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনের শহরগুলোতেও একই ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হাইফা শহরের ৭৫,০০০ ফিলিস্তিনি অধিবাসীকে টার্গেট করে জায়নবাদীরা নাশকতা ও সন্ত্রাসী হামলা চালাতে থাকে। যেমন: নির্বিচারে গুলি বর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ, প্রয়োজনীয় রসদ সরবারহ বন্ধ করা, গরম তেল ছিটিয়ে দেওয়া, এবং জাহাজে করে পালিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের স্নাইফার বন্ধুক দিয়ে টার্গেট করে হত্যা করা। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে দেওয়া নির্দেশ ছিলো, 


“কোন আরব দেখা মাত্রই তাকে হত্যা কর; স্থাপনাগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দাও; এবং বিস্ফোরণ দিয়ে প্রতিটি দরজা গুড়িয়ে দাও।” 


জায়নবাদীদের তান্ডব সফল হয়। প্রায় ৬০ হাজার ফিলিস্তিন আরব হাইফা ছাড়তে বাধ্য হয়। ফলে, ফিলিস্তিনে মুসলিম আরবদের সংখ্যা ৪৫ শতাংশ থেকে মাত্র ৪ শতাংশে নেমে আসে। হাইফা বিপর্যয়ের বর্ণনায় এক ফিলিস্তিনি বলেন,


 “মানুষ মানুষকে পাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে, নারীরা নিজেদের সন্তানদের বুকে জড়িয়ে আছে। গিজগিজ করতে থাকা নৌকাগুলো জীবন্ত কার্গোতে রূপ নিয়েছে। লোকের চাপে নৌকাগুলো বেসামাল হয়ে পড়ছে। কিছু নৌকা যাত্রীসহ উলটে গিয়ে সাগরের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে।”


হাইফার প্রতিচ্ছবি জাফা শহরটিকেও গ্রাস করে। শহরের ৯৫০০ জন ফিলিস্তিনি অধিবাসীকে অস্ত্রের মুখে শহর ছেড়ে পালাতে হয়। 


বস্তুত, ফিলিস্তিনের প্রতিটি শহর ও গ্রামের ভাগ্যে একই বিপর্যয় ঘটে।  ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের মেয়াদ যখন শেষ হয় তখন হিসেবে করলে দেখা যায় যে জায়নবাদীরা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ফিলিস্তিন আরবকে ফিলিস্তিন ছাড়তে বাধ্য করেছে। যেদিন জায়নবাদীরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন, তখন পর্যন্ত প্রায় ৫৮ টি ফিলিস্তিনি গ্রামকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে জায়নবাদী সন্ত্রাসীরা।  


তবে যে মুহুর্তে আরবরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অর্থাৎ, একদিকে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে আধুনিক অস্ত্র ও সামরিক অপারেশনে দক্ষ হয়ে উঠেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ফলে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়, এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রায় ৭৮% ফিলিস্তিনি ভূখন্ড দখল করে নেয়: ৭৫০,০০০ ফিলিস্তিনিকে ঘর ছাড়া করে; এবং প্রায় ৪০০ ফিলিস্তিনি গ্রামকে ধ্বংস করে।  


ফিলিস্তিনিদের শরনার্থী জীবনের সূচনা: 


ফিলিস্তিন বিপর্যয় বা নাকবা'র সময় লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি নিজেদের ভূখণ্ড ছেড়ে ফিলিস্তিনের সীমান্তবর্তী গাজা, পশ্চিম তীর, জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। কয়েক প্রজন্ম ধরে শরনার্থী হিসেবে ফিলিস্তিনিরা এই জায়গাগুলোয় বসবাস করে আসছে; দূর থেকে তাদের দখলকৃত ভূমিতে ইসরায়েলের অবৈধ স্থাপনা ও দেয়াল দেখে আসছে। তবে ইসরায়েলি নেতারা তাদের নাকবা পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত চালু রেখেছে যার বেশি ভুক্তভোগী গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা। 


১৯৬৭ সালের ৩য় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনের মূল ভূখন্ড সহ পার্শ্ববর্তী সিরিয়া, মিশর ও জর্ডানের ভূমি দখল করে। তাদের নতুন এজেন্ডা “গ্রেটার ইসরায়েল” বাস্তবায়নে এই অঞ্চল দখল করা তাদের জরুরি হয়ে পড়ে। তবে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দখলকৃত ভূমির অনেকাংশই ইসরায়েল ফেরত দিয়ে দেয়।


বিনিময়ে, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজার একটা বড় অংশ তারা ইসরায়েলের সাথে যুক্ত করে। এই জায়গা দখল করে জায়নবাদীরা অবৈধ ইহুদি স্থাপনা তৈরি করতে থাকে। জাতিসংঘ রেজুলেশনের মাধ্যমে ইসরায়েলের এহেন দখলদারিত্বকে অবৈধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বলছে।  


তবে অবৈধ স্থাপনার জন্য যখনই জায়গার প্রয়োজন পড়ে, ইসরায়েল অবশিষ্ট ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে সামরিক অপারেশন চালায়। ফলে ফিলিস্তিনি শরনার্থী ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। সাম্প্রতিক গাজায় ইসরায়েলের চালানো গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা অতীতের সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। আশংকা করা হচ্ছে যে গোটা গাজা অঞ্চলকেই ইসরায়েল এবার দখলে নিবে, ফলে অসংখ্য ফিলিস্তিনিরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে ফিলিস্তিন ছেড়ে পালাচ্ছে। 


চলমান ফিলিস্তিনি বিপর্যয় (Nakba): 


প্রায় ২-৩ মিলিয়ন ফিলিস্তিনি শরনার্থীদের ইসরায়েল কিছুতেই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দিচ্ছে না। সাম্প্রতিক গাজায় ইসরায়েলের চালানো নৃশংস গণহত্যা প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাকে আরও কমিয়ে দিলো। UN Partition Plan-এর সময় ফিলিস্তিনিদের যে ভূখণ্ড দেওয়া হয়েছিলো আজ তার প্রায় ৯০ শতাংশই ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্বের কবলে। ইসরায়েল দখলকৃত ভূখন্ডকে পাঁচটি ব্লকে ভাগ করেছে। ফলে, দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের (Two State Solution) সম্ভাবনা হয়তো আর বেচেঁ নেই। 


সাম্প্রতিক ইসরায়েলের গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা ফিলিস্তিনিদের জীবনকে আরও অনিশ্চিত ও অনিরাপদ করে তুলছে। এই লেখায় ফিলিস্তিন বিপর্যয়কে সংক্ষিপ্ত আকারে আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনেক আগ থেকেই ফিলিস্তিন ভূখণ্ড কেন্দ্রিক সঙ্কট শুরু হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে ব্রিটেন ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করে। ফিলিস্তিনিদের জীবনের সকল বিষয়কেই (ধর্ম, সাংস্কৃতি, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা) পরিকল্পনা মাফিক ধ্বংস করেছে ও করছে জায়নবাদী ইসরায়েল। 


প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তেফাদা বা জাগরণ ছিলো ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সামগ্রিক প্রয়াস। কিন্তু, ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার সামনে, এবং পশ্চিমা শক্তির ইসরায়েলপন্থি আচারণের প্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিদের কন্ঠস্বর ঢাকা পরে যাচ্ছে। 


অর্থাৎ, যে বিপর্যয় (Nakba) বা ধ্বংসলীলা ফিলিস্তিনিরা বিংশ শতকের প্রথম থেকেই সয়ে আসছে, বর্তমানেও সেই বিপর্যয় পূর্বের তুলনায় আরও ধ্বংসাত্মক হয়ে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বে আঘাত হানছে এবং তাদেরকে নিজ ভূখণ্ড ছাড়তে বাধ্য করেছে। এই বিপর্যয় থেকে মুক্তির পথ হয়তো এখন  আর খোলা নেই। ফলে, এক অনিশ্চিত জীবনের দিকে তাকিয়ে ফিলিস্তিনিরা। 




📝 বদিরুজ্জামান 
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়





Jerusalem Part: 

1. ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিবাসন: 

2. যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে ইসরায়েল লবি'র প্রভাব

3. BDS আন্দোলন: পশ্চিমে- ইসরায়েলের অবস্থান কাঁপিয়ে দিয়েছিলো যে মুভমেন্ট

4. দ্যা নাকবা (Nakba): ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ফিলিস্তিনি বিপর্যয়


No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.