Header Ads

Header ADS

বৈদেশিক সাহায্য (Foreign Aid): পরের পয়সায় উদ্ধার!

 বৈদেশিক সাহায্য (Foreign Aid): পরের পয়সায় উদ্ধার! 



ধনী (উন্নত) রাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য (Foreign Aid) কী দরিদ্র (অনুন্নত) রাষ্ট্রের পাওয়া উচিত, আর যদি পায় এই সাহায্য কী অনুন্নত/ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের দারিদ্রতা প্রশমিত করতে পারবে? এই প্রশ্নকে ঘিরে দীর্ঘদিনের আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ক রয়েছে। 

যেহেতু কারিগরী ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দরুন উন্নত রাষ্ট্রের সম্পদের পরিমান অনেকাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বৈদেশিক সাহায্যের সমর্থকদের ভাষায়- দারিদ্রপীড়িত রাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি অর্জন বা আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোগত উন্নয়নে দরকারি কারিগরী ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বিকাশে অনুন্নত রাষ্ট্রকে- উন্নত রাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা দেওয়া খুব জরুরি। 

রাষ্ট্র  সীমানার বাহিরে জাতিসংঘের মত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বল্প সুদে সীমিত আকারে অনুন্নত রাষ্ট্রকে সাহায্য করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প- বিশেষত দক্ষতা উন্নয়ন ও সামাজিক বিকাশ বিষয়ক প্রকল্পে এই সংস্থাগুলো সাহায্য করে (ক্ষুদ্র) ঋণ ও অনুদান আকারে। 

এছাড়াও, বিশ্বব্যাংক অনুন্নত রাষ্ট্রের স্থানীয় অংশীদার অথবা বেসরকারি বিনিয়োগকারীর সমন্বয়ে যৌভভাবে বিভিন্ন প্রকল্পে আর্থিক সাহায্য দেয়- যা বাণিজ্যিক ঋণ বা সুদের তুলনায় অনেক কম। 

বৈদেশিক সাহায্য (Foreign Aid) অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক হয় এবং আশা করা হয় এই আর্থিক সাহায্য দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। 

তবে, মজার ব্যাপার, ঔপনিবেশিক শক্তিও (যেমনঃ ব্রিটেন) এক সময় বলত যে ধনী রাষ্ট্রের একটা মৌলিক দায়িত্ব দারিদ্র্যকে সাহায্য করা। যদিও এই ঔপনিবেশিক শক্তিরা তাদের অধীনের উপনিবেশের (যাদের বর্তমানে তৃতীয় বিশ্ব বলা হয়) সম্পদ শোষণের মাধ্যমে নিজেদের শিল্পায়নকে  ত্বরান্বিত করেছে। বর্তমানেও, যখন তাদের দাবীকে সত্যে প্রমাণ করার সময় এসেছে- অর্থাৎ, বৈশ্বিক দারিদ্র্যতা হ্রাসে আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন-তখন তারা তাদের দায়িত্বে অবহেলা করছে বা অমনোযোগী। 

Foreign Aid নিয়ে এত সমালোচনা কেন? 

বৈদেশিক সাহায্য (Foreign Aid) যে দরিদ্র রাষ্ট্রের উন্নয়নে কোন মুখ্য ভূমিকা রাখেনা অনেক সমালোচক এমন মন্তব্য করেন। এই মন্তব্যের পিছনে শক্তপোক্ত অনেক কারণ উল্লেখ করা হয়। যথাঃ 

১। প্রথম কারণটি জাতিসংঘের শর্ত। যেখানে বলা হয় যখন উন্নত রাষ্ট্রের জিডিপির ১ শতাংশ পরিমান সম্পদের মালিকানা অনুন্নত দেশের হবে তখনই সে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার হকদার হবে।  তবে, এই মানদন্ডে ৩য় বিশ্বের খুবই কম দেশই নিজেদের নিয়ে যেতে পেরেছে।

এছাড়াও, আর্থিক সাহায্য দাতা দেশের ক্ষেত্রেও আর্থিক সাহায্য বিবেচনায় ওঠা-নামা লক্ষ্য করা যায়। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র, যে একদা বিশ্বের বৈদেশিক সাহায্যের সর্ববৃহৎ দাতা ছিলো,  সে বর্তমানে জাপান, জার্মান, ফ্রান্স, ব্রিটেনের থেকে বৈদেশিক সাহায্য দানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।

২। এছাড়াও, বৈদেশিক সাহায্যের মধ্যেও রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ভিত্তিক পার্থক্য রয়েছে। কোন রাষ্ট্র বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে আর্থিক অনুদান দেয়, কোন রাষ্ট্র প্রকল্প বা অবকাঠামো উন্নয়ন স্কিম হিসেবে সাহায্য করে, আবার কোন রাষ্ট্র সামরিক সরঞ্জাম অনুদান দেয়। এমনকি, কোন রাষ্ট্র soft Loan বা স্বল্প সুদে ঋণ হিসেবে বৈদেশিক সাহায্য প্রদান করে প্রভৃতি। 

যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে সামরিক সরঞ্জাম প্রদান করে- যা কোনভাবেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করে না। হিসেব করলে দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অদ্যাবধি যুক্তরাষ্ট্র যে বৈদেশিক সাহায্য প্রদান করেছে তার অধিকাংশই ছিলো তার মিত্রদের দেওয়া সামরিক সাহায্য। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের সিংহভাগই তার মিত্ররা পেয়েছে, যারা ততটা অনুন্নত নয়। 

আবার, দরিদ্র- রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্যকে অনেকে সমালোচনা করে বলেন- এই ধরনের বৈদেশিক সাহায্যের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বিদ্যমান। ফলে, এই সাহায্য ৩য় বিশ্বের সংঘাতময় অঞ্চল ও গোষ্ঠীকে আরও অস্থির করে তোলে- যা সার্বিকভাবে সেই অঞ্চলের গণতান্ত্রিক আদর্শ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যহত করে। বর্তমানে, মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার একটি জীবন্ত দৃষ্টান্ত। 

৩। বৈদেশিক সাহায্য (Foreign Aid) নিয়ে সমালোচনার অন্য একটি বড় কারণ হল যে রাষ্ট্র এই সাহায্য দেয় তার নানাবিদ উদ্দেশ্য থাকে, বিশেষত প্রদত্ত সাহায্য গ্রহীতা দেশ কোন কোন খাতে ব্যবহার করবে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ফলে, এই সাহায্য যে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে তা নিরূপণ সত্যিই দূরহ হয়ে পরে- কারণ দাতার প্রাধান্যের থেকে গৃহীত রাষ্ট্রের চাহিদা বা প্রাধান্য ভিন্ন হতে পারে। 

যেহেতু আগেই উল্লেখ করেছি, দরিদ্র রাষ্ট্র শুধু অর্থনীতিই সাহায্য হিসেবে পায় না- পাশাপাশি বিভিন্ন প্যাকেজ পায়- সামরিক সরঞ্জাম পায় এবং অন্যান্য। ফলে, এই সাহায্য কতটুকু কার্যকর হল তার মানদন্ড সম্পূর্ণভাবে মূল্যায়ন সম্ভব নয়। 

বস্তুত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটি রাষ্ট্রের যাবতীয় লক্ষ্য অর্জনে খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে বৈদেশিক আর্থিক সাহায্য একটি রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রভৃতি লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করতে পারে। 

অধিক সাহায্য, কম উন্নয়নঃ

মজার ব্যাপার হল, অনেক অনুন্নত রাষ্ট্রে বৈদেশিক সাহায্য ও উন্নয়ন বিপরীতমূখী আচারণ করে। যেমনঃ লাতিন আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ার অনুন্নত দেশের তুলনায় মুদ্রামানে বেশি বৈদেশিক সাহায্য পায় আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলো। 

কিন্তু বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারে আফ্রিকার দেশগুলোর উন্নয়নের তুলনায় লাতিন ও পূর্ব এশিয়ায় দেশগুলো তুলনামূলক অনেক ভালো করছে। এর কারণ কী? 

বৈদেশিক সাহায্য (Foreign Aid) ও রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধি বা প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তবে তন্মধ্যে, একটি কারণ খুবই স্পষ্ট। আফ্রিকার দেশগুলোয় বাৎসরিক বাজেটের স্থানীয় সক্ষমতা অনেকাংশেই কম। 

তাদের বাজেট প্রণয়নে বাৎসরিক যে বৈদেশিক সাহায্য পাবে তাকে যুক্ত করা হয়, ফলে স্থানীয়ভাবে অর্থের যোগান বা এই লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের আগ্রহ বা প্রচেষ্টা বা স্থানীয় পর্যায় থেকে সেরূপ চাপ থাকে না। 

এছাড়াও, স্থানীয় পর্যায়ে অর্থের যোগান বা GNP কম হওয়ায় বৈদেশিক সাহায্য থেকে যে অর্থ পাওয়া হয় তা দেশের মুদ্রাস্ফীতিকে উস্কে দিতে পারে। কারণ, ভারসাম্য রাখার মত প্রয়োজনীয় বৈদেশিক রিজার্ভ এই দেশগুলোর নেই যা তুলনামূলক কম হলেও লাতিন ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় আছে। 

বৈদেশিক সাহায্য ও অর্থনৈতিক সংস্কারঃ 

এছাড়াও, বৈদেশিক আর্থিক সাহায্য রাষ্ট্রকে কোন আত্মঘাতি অর্থনৈতিক সংস্কার থেকে রক্ষা করে। কারণ, এই সাহায্য রাষ্ট্রকে একটা স্থিতি প্রদান করে, এবং আন্তর্জাতিক মানের অর্থনৈতিক সংস্কার নীতি প্রণয়নের পক্ষে স্থানীয় সমর্থনের প্রচেষ্টা চালায়। 

লাতিন আমেরিকার চিলিতে সিকাগো বয়েজ বুদ্ধিজীবী সংঘ এমন একটি সংস্কার যা পশ্চিমা দাতা গোষ্ঠীর আদলে গড়ে ওঠ। আবার, পূর্ব এশিয়ায় ASEAN এবং একইভাবে পূর্ব এশিয়াও পশ্চিমা দাতা রাষ্ট্রের অনুকরণে তাদের অর্থনীতিকে বাজারমুখী/ রপ্তানিমূখী করেছে। 

অনেক সমালোচক বলেন, বৈদেশিক সাহায্য রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে। রাষ্ট্রের পলিসিতে দাতা রাষ্ট্রের স্বার্থও অনেক সময় যুক্ত করতে হয়। এটি সবচেয়ে বেশি হয় যখন অর্থনৈতিক সংস্কারে স্থানীয় পর্যায়ে নিজস্ব যোগানের ব্যাপারে সচেতন না হয়। 

ফলে, স্থানীয় পর্যায়ে সম্পতির দুর্নীতিবাজ বা গণতন্ত্র বিরোধী শক্তিকে বৈদেশিক সাহায্য পেতে বেশি আগ্রহী করে তোলে। কারণ, গণতান্ত্রিক পরিবেশে অনেক ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য জনগণ সরকারকে চাপ দেয়। 

ক্ষতি জেনেও এত আগ্রহ কেন?

গ্রহীতারা তো জানে যে দাতাদের বৈদেশিক সাহায্য (Foreign Aid) দেওয়ার শর্তগুলো যা অনেকাংশেই তাদের জন্য আত্মঘাতী। তবুও কেন বা কিভাবে তারা বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার জন্য মরিয়া বা আগ্রহী? 

আদতে, শর্ত হিসেবে দাতারা বলে অনুন্নত দেশকে বৈদেশিক সাহায্য তারা ঋণ হিসেবে দিবে, তবে স্বল্পসুদে। তবে, এই ঋণ পেতে হলে গ্রহীতাকে দাতা রাষ্ট্রের দেওয়া শর্ত পূরণ করতে হবে- এমনকি যখন ঋণের অর্থ ফেরত দিবে তখনও তাদের কিছু শর্ত মেনে বৈদেশিক সাহায্য ফেরতও দিতে হবে। 

গত দশকে বৈদেশিক সাহায্য দাতা প্রদত্ত শর্ত বেড়েছে, বেড়েছে সাহায্য হিসেবে দেওয়া ঋণের শর্তও- তবে, গ্রহীতার পক্ষ থেকে যে সকল দফা উপস্থাপন করা হয় দাতাদের নিকট তা গৃহীত হয়েছে খুবই অল্প। 

বেশি বেশি শর্ত যুক্ত হওয়ায় গ্রহীতার পক্ষে স্থানীয় সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ অনেক জটিল হয়ে উঠেছে। কারণ দাতাদের শর্ত অনুসারে সংস্কারের পথ তাদের বেছে নিতে হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা বা দাবী সত্ত্বেও সেরূপ পদক্ষেপ বৈদেশিক সাহায্য গৃহীত বা নির্ভরশীল দেশ নিতে পারছে না। বর্তমানের বাংলাদেশ সরকার উপস্থিত প্রত্যয় স্কিম তার অন্যতম উদাহরণ। 


সাহায্যের যাঁতাকলঃ 

ফলে, বৈদেশিক আর্থিক সাহায্য (Foreign Aid) একটি দুষ্ট চক্রে (Vicious Circle) পরিণত হয়েছে। এখানে গ্রহীতার দাবীর বিপরীতে দাতার পক্ষের শর্তের পরিমান বাড়ছে; নতুন শর্ত গ্রহীতাদের পক্ষে হজম (গ্রহণ) করা কষ্টকর/ আত্মঘাতী হয়ে পরেছে; এবং দাতার কড়া শর্তের বিপরীতে গ্রহীতারা না চাইতেও আবারও নতুন নতুন চাহিদা উপস্থাপন করছে- দাতারা সে নতুন দাবীকে টার্গেট করে আরও শক্ত শর্ত গ্রহীতা দেশকে মানতে বাধ্য করছে, এবং এভাবেই এই চক্রটি চলছে। 

এছাড়াও, দাতাদের পক্ষ থেকে সাহায্য পাওয়ার শর্তগুলোকে গ্রহীতাদের মানার জন্য চাপ দেওয়া হয়। এমনকি শর্ত না মানলে বা কোন শর্ত ভঙ্গ করলে সাহায্য দেওয়া বন্ধের হুমকিও দেওয়া হয়। 

তবে, দাতা রাষ্ট্র তাদের অধিকাংশ বৈদেশিক সাহায্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দিয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়টি হল, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথে এই গ্রহীতাদের এক ধরনের লিয়াজু থাকে। এমনকি এই কর্মকর্তাদের প্রমোশন বৃদ্ধিতেও ব্যাংকের ঋণের পরিমান বাড়াতে হয়। 

অতএব, বিশ্বব্যাংক নানা উপায়ে সেই সাহায্য ঋণ হিসেবে গ্রহীতা দেশকে দেয়। ফলে, দাতা রাষ্ট্রের দেওয়া শর্তকে ভালোভাবে না মেনেও অনেক অনুন্নত দেশ ঋণ হিসেবে সেই বৈদেশিক সাহায্য পেয়ে থাকে। 





ভাবানুবাদকঃ 
বদিরুজ্জামান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়  

 

মূল বই: 
International Relations: The Key Concepts 
By- Martin Griffith, Tarry O'Callaghan & Steven C. Roach



No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.